ঢাকা, শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৭:১৯ পূর্বাহ্ন
৬০০ টাকা বেতনের জুতা শ্রমিক থেকে কাউন্সিলর নাজমা
ডেস্ক রিপোর্ট ::

নাজমা বেগম। একটা সময় জুতা তৈরির কারখানায় সাধারণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন। মাত্র ৬০০ টাকা বেতনে কাজ করতেন তিনি। এই সংগ্রামী নারীর জীবনে সফলতা ধরা দিয়েছে।

কঠোর পরিশ্রম ও মেধার জোরে আজ নাজমা স্বাবলম্বী। আর্থিকভাবে সচ্ছল হওয়ার পাশাপাশি বর্তমানে তিনি গাজীপুরের কালিয়াকৈর পৌরসভার ৭, ৮ ও ৯নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর।

নাজমার জন্ম কালিয়াকৈর উপজেলার কারল সুরিচালা গ্রামে মধ্যবিত্ত পরিবারে। তার বাবার নাম উছুম উদ্দিন। তারা ৬ বোন ও ৫ ভাই। বোনদের মধ্যে নাজমাই সবার ছোট। ১৯৮৮ সালে একই উপজেলার অলিয়ার চালা এলাকার হাতেম আলীর ছেলে আবুল হোসেনের সঙ্গে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় তার। বিয়ের কিছু দিন পর থেকেই খুব অভাবের মধ্য দিয়ে চলছিল নাজমা বেগমের সংসার জীবন।

তখন তার স্বামীর তেমন কোনো কাজকর্ম না থাকায় খাওয়া পরা কষ্টকর হয়ে উঠেছিল। এমন পরিস্থিতির মধ্যে নিরুপায় হয়ে পড়েন নাজমা বেগম। ওই এলাকার নারীরা তখন চাকরি করত না। নারী বাড়ির বাইরে কাজ করবে শুশুরবাড়ি থেকে মানা। সেই বারণ উপেক্ষা করে একপর্যায়ে ১৯৯১ সালের শুরুর দিকে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চলে আসেন নাজমা।

একই উপজেলার হরিণহাটি এলাকায় ওই বছরের ১৪ নভেম্বর অ্যাপেক্স ফুডওয়্যার নামের জুতা তৈরির একটি কারখানায় লাস্টিং সেকশনে মাত্র ৬০০ টাকা বেতনে চাকরি নেন তিনি। কিছু দিন চাকরি করার পর নাজমা বেগম তার বাবার সহযোগিতায় কারখানার পাশেই তিন শতাংশ জমি কিনেন। পরে সেখানে কোনো রকমে মাথা গোঁজার ঠাঁই করেন। এর পর টানা প্রায় ১৪ বছর একই কারখানায় চাকরি করেন নাজমা। ততদিনে বেতন বেড়ে হয় মাত্র সাড়ে তিন হাজার টাকা।

ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় শুরু হয় নাজমার সংগ্রামী জীবন। পরিশ্রম, নিষ্ঠা, সততা আর মেধাকে পুঁজি করে ব্যবসায় নামেন এই আত্মপ্রত্যয়ী নারী। ২০০৪ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাড়ির পাশেই একটি খাবারের হোটেল শুরু করেন নাজমা। কয়েক বছর পর তিনি খাবার হোটেলের ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে শুরু করেন ডিমের আড়তের ব্যবসা, যা এখনও চলমান রয়েছে।

ধৈর্য ও সততার সঙ্গে নিজ কর্মপ্রচেষ্টায় এখন দিন পাল্টে গেছে নাজমার জীবন। তিনি নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সব প্রতিকূলতাকে জয় করে আজ স্বাবলম্বী নারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন।

নাজমা এলাকার মানুষের সেবায় মনোনিবেশ করেন। ২৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত কালিয়াকৈর পৌরসভা নির্বাচনে ৭, ৮ ও ৯নং ওয়ার্ডে নির্বাচন করে বিপুল ভোটে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।

নাজমা বেগম জানান, চাকরি জীবনের প্রথম যেদিন তিনি কারখানায় কাজে গিয়েছিলেন সেদিন চামড়ার গন্ধে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। এর পর ধীরে ধীরে এসব মানিয়ে নিয়েই চাকরি করেছেন। যত কষ্টই হোক না কেন কখনও জীবন সংগ্রামের পথে হার মানেননি তিনি। কারখানায় কাজও দ্রুত শিখে যান তিনি। তার সঙ্গে তার বড় বোন সুরাইয়া বেগমও একই কারখানায় চাকরি করতেন। দ্রুত কাজ শিখে যাওয়ার কারখানার মালিক পর্যন্ত তাকে খুবই পছন্দ করতেন। তাদের মালিক কারখানায় যখনই আসতেন ঘুরে ঘুরে শ্রমিকদের খোঁজ খবর নিতেন। কারখানায় ভালো কাজ করার কারণে মালিক তার নামটাও জানতেন। চাকরি ছেড়ে দিয়ে যখন ব্যবসা শুরু করেন তখন তার স্বামী আবুল হোসেনও তাকে সর্বদা সহযোগিতা করেন। দুজনের বেশ আয় হতে থাকে। তা দিয়েই জমি কিনেছেন।
বর্তমানে নাজমাদের দুটি বহুতল ভবন রয়েছে। ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়েও চলাচল করেন।

নাজমা আবুল দম্পতির তিন মেয়ে রয়েছে। বড় মেয়ে আমেনা আক্তার মিতু নিজেদের বাড়িতেই পার্লারের ব্যবসা করেন। মেজ মেয়ে আনিতা সুলতানা আশামনি এবার এইচএসসি পাশ করেছে এবং ছোট মেয়ে ফাতেমা ইয়াসমিন চাঁদনী এবার এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।

তিনি আরও বলেন, মানুষের জন্য কিছু করার ইচ্ছা থেকেই নির্বাচন করার আগ্রহ হয়। এর পর ২০১১ সালের নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর হিসাবে কালিয়াকৈর পৌরসভার ৭ ,৮ ও ৯নং ওয়ার্ড থেকে নির্বাচন করে অল্প কিছু ভোটের ব্যবধানে হেরে যান তিনি। কিন্তু হেরে গিয়েও থেমে যায়নি অপেক্ষা করেছেন মানুষের পাশে থেকে তাদের জন্য কাজ করেছেন। অন্যের বিপদ আপদের এগিয়ে এসেছেন এবং তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। এমনিভাবে দীর্ঘ প্রায় দশ বছর পর আবার কালিয়াকৈর পৌরসভার তফসিল ঘোষণা হলে নাজমা বেগম পুণরায় নির্বাচনি প্রচার শুরু করেন। একপর্যায়ে গত বছরের ২৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয় পৌরসভার নির্বাচন। সেখানে তিনজন নারী কাউন্সিলর প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১৬ হাজার ৫৮৭ ভোট পেয়ে নাজমা বেগম জয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ভোট পান ৫ হাজার ৯৮৩ ভোট। এরই মধ্যে তিনি তার নির্বাচনি ওয়ার্ডগুলোতে নানা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড শুরু করেছেন।

নাজমা বেগম বলেন, ওয়ার্ডবাসীকে কথা দিয়েছেলাম নির্বাচিত হলে এলাকার পরিষ্কার-পরিছন্নতা নিয়ে কাজ করব। সেই কাজ ইতোমধ্যে শুরু করা হয়েছে। সম্প্রতি পৌরসভার ৭ ও ৮নং ওয়ার্ডে আনুষ্ঠানিকভাবে মেয়র মজিবুর রহমান ও স্থানীয় কাউন্সিলরদের সহযোগিতায় পরিছন্নতা কাজের উদ্বোধন ঘোষণা করা হয়েছে।

হরিণহাটি এলাকার বাসিন্দা আবুল কালাম বলেন, নাজমা বেগম একজন পরিশ্রমী নারী। তিনি জীবনে কঠোর প্ররিশ্রম করেছে। জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করেই তিনি এ পর্যন্ত এসেছেন। তিনি কাউন্সিলর হলেও অতীতকে কিন্তু ভুলে যাননি। এখনও তিনি তার চাকরি জীবনের কথা এবং তার সেই প্রতিষ্ঠান তাকে নানাভাবে সহযোগিতা করার সেই গল্প করেন।

কালিয়াকৈর পৌরসভার মেয়র মজিবুর রহমান বলেন, জনপ্রতিনিধি হতে গেলে একটা মানুষের মধ্যে যে গুণাবলি থাকা প্রয়োজন নাজমার মধ্যে সেই গুণাবলি রয়েছে। তাই এলাকার জনগণ তাকে বিপুল ভোটে জয়ী করেছেন। তিনি এলাকার জনগণকে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সেগুলো যাতে পূরণ করতে পারেন, তার জন্য সব রকমের সহযোগিতা তাকে করা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *