মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গা পুরুষদের সেনাবাহিনীতে যোগদানের জন্য বাধ্য করার অভিযোগ উঠেছে জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে। এসব রোহিঙ্গা রাখাইনে আশ্রয়শিবির ও কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দা। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ – জান্তা সরকার যুদ্ধেক্ষেত্রে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করা জন্য রোহিঙ্গাদের নিয়োগ দিচ্ছে।
স্থানীয় রোহিঙ্গা নেতা ও বাসিন্দারা জানান, ইতোমধ্যে রাখাইন রাজ্যের কয়েকটি গ্রাম ও আশ্রয়শিবির থেকে অন্তত ৪০০ জন রোহিঙ্গা পুরুষকে দুই সপ্তাহের প্রাথমিক প্রশিক্ষণের জন্য সামরিক ঘাঁটিতে পাঠানো হয়েছে। এসব রোহিঙ্গাদের সবার বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি সামরিক বাহিনীতে বাধ্যতামূলক নিয়োগ সংক্রান্ত আইন পাসের পর রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে সেই প্রক্রিয়ার আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেছে জান্তা সরকার। যদিও আইনটিতে বলা আছে সামরিক বাহিনীতে মিয়ানমারের সব তরুণ-তরুণী নাগরিকের যোগদান বাধ্যতামূলক। অন্তত দুই বছর সামরিক বাহিনীতে চাকরি করতে হবে। কিন্তু নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নিজেদের বিধান চাপিয়ে দেওয়া আইনের লঙ্ঘন হিসেবে দেখছেন মানবাধিকারকর্মীরা।
রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা বাসিন্দারা জানান, জান্তার সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গা পুরুষদের বলেছে তারা সেনাবাহিনীতে চাকরি করলে প্রত্যেককে এক বস্তা চাল, নাগরিকত্বের পরিচয়পত্র এবং মাসিক ১ লাখ ৫০ হাজার কিয়াট (৪১ ডলার) বেতন পাবে।
রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে কাজ করেন ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা নে সান লুইন। তিনি বলেন, প্রশিক্ষণের সময়কাল মাত্র দুই সপ্তাহ। চলমান সংঘাতে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করার জন্য রোহিঙ্গাদের নিয়োগ দিচ্ছে জান্তার সামরিক বাহিনী।
সামরিক বাহিনীতে বাধ্যতামূলক নিয়োগের আইনটি পাসের পর রাখাইন রাজ্যের বুথিডাং, মংডু ও সিত্তওয়ে শহরের বিভিন্ন গ্রাম ও আশ্রয়শিবিরে গিয়ে সামরিক বাহিনীতে নিয়োগের জন্য রোহিঙ্গাদের তালিকা দেওয়ার জন্য রোহিঙ্গা নেতা ও স্থানীয় প্রশাসনের ওপর চাপ প্রয়োগ করে জান্তা সরকার। রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত প্রতিটি ছোট গ্রাম থেকে অন্তত ৫০ জন ও প্রতিটি ছোট আশ্রয়শিবির এবং বড় গ্রাম থেকে অন্তত ১০০ জন পুরুষের তালিকা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।
এর মধ্যে গত বুধবার (২১ ফেব্রুয়ারি) রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিত্তওয়ে শহরের অবস্থিত আশ্রয়শিবির থেকে অন্তত ৩০০ জনের নামের খসড়া করা হয়েছে। তারা এখন সামরিক প্রশিক্ষণের মাঠে রয়েছে। এ ছাড়া জান্তা সৈন্যরা গত ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি রাখাইনের বুথিডাং শহরের চারটি গ্রাম থেকে অন্তত ১০০ জন রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য কাছাকাছি এলাকায় অবস্থিত একটি সামরিক ঘাঁটিতে পাঠানো হয়েছে। এর বাইরেও আশ্রয়শিবির থেকে আরও ৩০০ রোহিঙ্গাকে ধরে নিয়ে সিত্তওয়েতে আর্টিলারি ব্যাটালিয়নের ৩৭৩ নামক সামরিক ঘাঁটিতে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠিয়েছে জান্তার সামরিক বাহিনী।
২০১২ সালে রাখাইনে জাতিগত ও ধর্মীয় সহিংসতার কারণে বাস্তুচ্যুত হওয়া প্রায় ১ লাখ রোহিঙ্গার জন্য একই রাজ্যের রাজধানী সিত্তওয়েতে ১৩টি আশ্রয়শিবির ক্যাম্প তৈরি করা হয়। স্থানীয় বাসিন্দা ও অধিকারকর্মীরা বলছেন, এসব ক্যাম্প থেকে ৩০০ জনের একটি দল জান্তা সরকার নিয়ে গেছে। এখন আরও একটি গ্রুপ নেওয়ার জন্য তাদের নামসহ আরও ৩০০ জনের একটি তালিকা দেওয়ার জন্য বলেছে জান্তার সামরিক বাহিনী।
রোহিঙ্গারা বলছেন, যাদেরকে নেওয়া হয়েছে তাদের জন্য আমরা উদ্বিগ্ন। এখন নতুন করে আবার তালিকা করায় আমরা ভীত। আর এই তালিকা শিগগিরই হবে।
সিত্তওয়ের একটি আশ্রয়শিবির ক্যাম্পের কাছে একটি গ্রামের বাসিন্দা রোহিঙ্গা যুবক কো আয় জানান, জান্তা সরকারের সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়ার সীমা বেঁধে দেওয়া বয়সের মধ্যে থাকায় তিনি নিজে এবং তার পরিবার বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। জান্তা সরকারের পক্ষে অস্ত্র তুলে সামনের সারিতে নিহত হওয়ার বদলে আমরা বরং তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে আরাকান আর্মিতে যোগ দেব।
গত বছরের ২৭ অক্টোবর উত্তরাঞ্চলীয় শান রাজ্যে শুরু হওয়া জান্তাবিরোধী বিদ্রোহের নেতৃত্বদানকারী ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের তিনটি জাতিগত সেনাবাহিনীর মধ্যে আরাকান আর্মি অন্যতম। যুদ্ধে জান্তার সামরিক বাহিনী রাখাইনে আরাকান বাহিনীর কাছে বড় ধরনের পরাজয় বরণ করছে। এ ছাড়াও দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় শান রাজ্যে জান্তার সামরিক বাহিনীর বড় ধরনের পরাজয় ঘটে।
সূত্র : ইরাবতী
Leave a Reply