ঢাকা, শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১১:০৭ পূর্বাহ্ন
সিম নিতে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে আঙুলের ছাপ!
উখিয়া নিউজ ডেস্ক :

অপরাধ দমন এবং প্রকৃত অপরাধী শনাক্তে ২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর থেকে আঙুলের ছাপ বা বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সব মোবাইলের সিম রেজিস্ট্রেশন ব্যবস্থা চালু করে সরকার। একটি জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) বিপরীতে সর্বোচ্চ ১৫টি সিম রাখার বিষয় চূড়ান্ত করা হয় তখন। তবে সাত বছর আগে চালু করা এই সুরক্ষিত পদ্ধতির সুফল কতটা মিলেছে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

জাগো নিউজের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম বিক্রি করা হলেও একজনের এনআইডি বা বায়োমেট্রিকে মোবাইল সিম বিক্রি করা হচ্ছে অন্যদের কাছে। সিম পাওয়া যাচ্ছে রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে অনলাইনেও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন দিয়ে একাধিক চক্র ভিআইপি ও সাধারণ সিম বিক্রি করছে উচ্চমূল্যে। এসব সিম দিয়ে কেউ অপরাধ করলে ফেঁসে যাবেন অন্য ব্যক্তি।

কুমিল্লার সাফিকুন নেসা (ছদ্মনাম) নামের ৬৫ বছরের একজন বৃদ্ধার জাতীয় পরিচয়পত্র ও হাতের ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যবহার করে ১০টির বেশি সিম অ্যাকটিভ করে নেন এক দোকানদার। এরপর প্রতিটি সিম ১ হাজার ২০০ টাকা করে বিক্রি করেন একটি ডাকাত দলের কাছে। এসব সিম দিয়ে যোগাযোগের মাধ্যমে ডাকাতি শুরু করে সেই ডাকাতদল। দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে সংঘবদ্ধ এ ডাকাত দলের পাঁচজনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা (ডিবি) গুলশান বিভাগ।

নরসিংদীর বাসিন্দা জাকির হোসেন (ছদ্মনাম)। মেরামতের জন্য সিমসহ একটি মোবাইল রেখে আসেন সার্ভিসিংয়ের দোকানে। এরপর দোকানদার তাকে জানান মোবাইলটি মেরামতযোগ্য নয়। এ তথ্য জানার পর অল্প দামি মোবাইলটি জাকির আর ফেরত নেন না। সেখানেই ঘটে বিপত্তি। দোকান থেকে তারেক সরকার (৩৫) নামের এক প্রতারক মোবাইল কিনতে গিয়ে জাকিরের নামে রেজিস্ট্রেশনকৃত রবি অপারেটরের সিমটি নিয়ে আসেন। সেই সিম দিয়ে তারেক আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকের পরিচয়ে  স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবকে মোবাইল ফোনে চাকরির সুপারিশ করতে গিয়ে ধরা পড়েন ডিবির জালে। এরপর উন্মোচিত হয় জাকিরের সিমের রহস্য।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ, কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট ও র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) একের পর এক অভিযানে বেরিয়ে আসে অসংখ্য গ্রাহকের এনআইডি ও ফিঙ্গার প্রিন্ট ব্যবহার করে নিবন্ধিত সিম দিয়ে প্রতারণার বিষয়টি।

এমন জালিয়াতি বন্ধে দীর্ঘদিন ধরে তাগাদা দিয়ে আসছেন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা। যদিও মোবাইল ফোন অপারেটরদের দাবি, যথাযথ প্রক্রিয়া মেনেই সিম সরবরাহ করেন তারা।

জানা যায়, ২০১৬ সালের ৩ এপ্রিল রাতে বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার জুয়ানপুর গ্রামে জঙ্গিদের ভাড়া করা একটি বাড়িতে  বোমা তৈরির সময় বিস্ফোরণে দুজন নিহত হন। এদের মধ্যে একজন ছিলেন জেএমবির চট্টগ্রাম অঞ্চলের সামরিক শাখার প্রধান রাইসুল ইসলাম খান ওরফে ফারদিন। তার ব্যবহার করা সব সিম ছিল অন্যজনের নামে নিবন্ধিত।

২০১৬ সালের ৭ মার্চ গভীর রাতে রাজধানীর খিলগাঁওয়ে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন জেএমবি কমান্ডার পিয়াস। তার ব্যবহৃত সিমটি নিবন্ধিত ছিল চট্টগ্রামের রাউজানের মামুনের নামে। ২০১৭ সালের ৭ মে সাভারের আশুলিয়া এলাকা থেকে গ্রেফতার জঙ্গি মো. ইমরান হোসেন ওরফে এমরানের ব্যবহৃত সিমটি নিবন্ধিত ছিল রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার আবদুর রবের নামে। এছাড়া রশিদ খান ও মিজানুর রহমানের নামে নিবন্ধিত একাধিক সিমও ব্যবহার করেন তিনি। ২০১৭ সালের ১ মে রাজধানীর ভাটারা থানার নর্দা এলাকা থেকে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন  আনসার আল ইসলামের ‘তথ্য-প্রযুক্তি বিভাগের প্রধান’ আশফাক উর রহমান অয়নকে গ্রেফতার করা হয়। তার ব্যবহৃত সিমগুলো নিবন্ধিত ছিল রবিউল ও আবদুল্লাহর নামে।

২০১৫ সালের ৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ বোস্তামি থানার বক্সনগর হক টাওয়ারের দ্বিতীয় তলা থেকে জেএমবি সদস্য মো. সুজন ওরফে বাবুকে গ্রেফতার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। বায়েজিদ বোস্তামি থানার বাংলাবাজার এলাকার ল্যাংটা মামা ও তার খাদেম আবদুল কাদেরকে গলা কেটে হত্যা করে বাবুসহ কয়েকজন জঙ্গি সদস্য। বাবু জঙ্গি কর্মকাণ্ডে যে সিমটি ব্যবহার  করেছিলেন, তা নিবন্ধিত ছিল ঝিনাইদহের বাবর আলীর নামে।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, এনআইডি ও ফিঙ্গার প্রিন্ট ছাড়াও কয়েকটি চক্র ভুয়া এনআইডি দিয়ে সিম বিক্রি করছে। আমরা খবর পেয়েছি, এসব সিম উচ্চমূল্যে বাজারে কিনতেও পাওয়া যায়। এছাড়া একজনের এনআইডি ও ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে তার অজান্তেই একাধিক সিম রেজিস্ট্রেশন করা হচ্ছে। সেগুলো আবার উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে অপরাধীদের কাছে। এসব সিম দিয়ে অপরাধীরা জড়াচ্ছেন ভয়ঙ্কর সব অপরাধে। অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সিম ব্যবহার করে অপরাধ করলেও তাদের ধরতে বেগ পেতে হচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। অভিযানে সিমের সূত্র ধরে নিরপরাধ ব্যক্তিকে পাওয়া গেলেও অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকার চেষ্টা করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *