ঢাকা, শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৪:৪৬ পূর্বাহ্ন
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চাপা আতঙ্ক, স্বস্তিতে নেই স্থানীয়রা
সাখাওয়াত কাওসার, বাংলাদেশ প্রতিদিন ::

একের পর এক খুনখারাবিতে রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো। নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এ ঘটনাগুলো ঘটছে। এ ছাড়া ক্যাম্পগুলোয় অচেনা মানুষের আনাগোনায় রীতিমতো ভীতসন্ত্রস্ত নিরীহ রোহিঙ্গারা। এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৮০টি খুনের ঘটনা ঘটেছে।

 

এর মধ্যে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে চলতি বছর ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত  ঘটেছে ৬৯টি খুনের ঘটনা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্যদের টহলের পরও এমন ঘটনায় স্বস্তিতে নেই স্থানীয়রা। তারা ভুগছেন নানামুখী আতঙ্কে। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় দায়িত্ব পালনরত দেশি-বিদেশি সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতার কারণে ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে মোড় নিতে পারে।
টানা কয়েক দিন সরেজমিন রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে জানা গেছে, দিনে নীরব থাকলেও সন্ধ্যা নামার পরই ক্যাম্পগুলোয় আনাগোনা শুরু হয় অচেনা মানুষের। মাঝেমধ্যেই তারা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে মাথায় হেলমেট ও অস্ত্র হাতে টহল দেয়। তাদের ভয়ে রীতিমতো তটস্থ নিরীহ রোহিঙ্গারা। বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেই তাদের ওপর নেমে আসে নরকযন্ত্রণা।
তাদের ঘরের স্ত্রী ও যুবতী মেয়েদের জোরপূর্বক তুলে নেওয়া হয়। দেওয়া হয় প্রাণনাশের হুমকি। ১২ নম্বর ক্যাম্পের একজন মাঝি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নিরীহ রোহিঙ্গারা অতিষ্ঠ হয়ে এরই মধ্যে আরসার কমান্ডার মুছা, কমান্ডার মাস্টার আনোয়ারসহ ছয় ক্যাম্প কমান্ডারকে গণপিটুনির পর পুলিশে দিয়েছে। এর পর থেকে আমরা আরও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছি। আমাদের অনেককে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে তারা।
অল্প কয়েকজন পুলিশ কীভাবে আমাদের নিরাপত্তা দেবে? না ঘুমিয়ে আমরা রাতযাপন করি। ’ ১৮ নম্বর ক্যাম্পের রোজিনা (৬০) বলেন, ‘কয়েকদিন আগে আমাদের ছয়জনকে নৃশংসভাবে খুন করেছে ওরা। মাদরাসায় লুটপাট করেছে। মাঝেমধ্যেই অনেক লোক নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে। তাদের আর পাওয়া যাচ্ছে না। ’ ১৮ নম্বর ক্যাম্পের এইচ-৫২ নম্বর ব্লকের দারুল উলুম নাদওয়াতুল উলামা আল-ইসলামিয়া মাদরাসায় ২২ অক্টোবর ভোররাতে দুর্বৃত্তরা ছয়জনকে নৃশংসভাবে খুন করে। তাদের হাতে নিহত মো. আমিনের বাড়ি মাদরাসার কাছে। তার বৃদ্ধ মা লায়লা বেগমের সঙ্গে কথা বলতেই তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন। স্বামীহারা এই বৃদ্ধার তিন মেয়ে আর একমাত্র ছেলে ছিলেন আমিন। মাদরাসায় নিরীহ ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর নারকীয় হামলার খবর শুনে তিনি তাদের রক্ষা করতে সেখানে গিয়েছিলেন। ছয়জন নিহত ছাড়া আরও সাতজন গুরুতর আহত হয়েছেন দুর্বৃত্তদের হামলায়। সূত্র বলছেন, উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বড় একটি অংশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে আরসা নামক বিদ্রোহী সংগঠন। ক্যাম্পে রয়েছে আরসার ব্লকভিত্তিক কমান্ডারদের নেতৃত্বে বিশেষায়িত ইউনিট। কিছুদিন আগ পর্যন্ত ক্যাম্পের ভিতরেই তারা রাতে প্রশিক্ষণ কর্মকান্ড চালাত। তবে সংগঠনের সদস্যরা মূলত প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন মিয়ানমারে। এদিকে আরসার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় মাথা চাড়া দিচ্ছে আরএসও, আলেখিন, আল মাহাজসহ অন্তত ১৫টি বিদ্রোহী সংগঠন। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এসব সংগঠনের ব্যানারেই মিয়ানমার থেকে নিয়মিতভাবে আসছে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক, অস্ত্র ও চোরাই পণ্য। আর ৩৪টি ক্যাম্পে গড়ে ওঠা অন্তত ৩০০ মাদরাসা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নামে বিদেশ থেকে আসা হুন্ডির ভাগবাটোয়ারা নিয়ে তারা বিরোধে জড়িয়ে পড়ছে। হুন্ডির টাকা নিয়ে নানা বিরোধের বিষয়টি স্বীকার করে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ইনচার্জ রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘কাদের নামে হুন্ডির অর্থ আসছে এ বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। তবে ক্যাম্পের মাদরাসাগুলোর বিষয়ে সরকার থেকে কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়নি। ’ ২৯ সেপ্টেম্বর প্রথমে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে, ২৩ অক্টোবর সন্ত্রাসীরা মাদরাসায় ঢুকে গুলি চালিয়ে আরও ছয় রোহিঙ্গাকে হত্যা করে। এর আগে ২০১৮ সালের ১৮ জুন রাত ৮টার দিকে বালুখালী-২ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের প্রধান মাঝি, মুহিবুল্লাহর বড় ভাই আরিফুল্লাহকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে। ওই ঘটনাটি বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। ২০২০ সালের ৫ অক্টোবর কুতুপালং ক্যাম্পে মো. ইয়াসিন (২৪) নামে এক রোহিঙ্গা যুবক খুন হন।
অভিযোগ রয়েছে, ক্যাম্পের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ইয়াসিন খুন হন। সীমান্তে বসবাসকারী কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা জানান- উখিয়ার বালুখালী, ময়নার ঘোনা, হাকিমপাড়া, কুতুপালং, জামতলী, তাজনিমার খোলা ও শফিউল্লাহ কাটা ক্যাম্পগুলো মিয়ানমার সীমান্তবর্তী হওয়ায় রোহিঙ্গারা কৌশলে ক্যাম্প থেকে বের হয়ে নিয়মিতভাবে মিয়ানমারে যাতায়াত করে। যে কারণে প্রতিনিয়ত মিয়ানমার থেকে ইয়াবা, মাদক, অস্ত্র ও সোনার চালান এপারে আসছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গুটিকয় চালান আটক হলেও বৃহত্তর চালানগুলো ঢুকে পড়ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। পরে সুযোগ বুঝে এসব পাচার হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। এসবও নিয়ন্ত্রণ করে বিদ্রোহী রোহিঙ্গা সংগঠনগুলো। কক্সবাজার জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম ব বলেন, ‘মুহিবুল্লাহ হত্যার ঘটনায় আমরা নয়জনকে গ্রেফতার করেছি। এর মধ্যে দুজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ছয় খুনের ঘটনায় আমরা এর মধ্যে ১১ জনকে গ্রেফতার করেছি। এর মধ্যে পাঁচজন এজাহারভুক্ত আসামি। ঘটনার তদন্তে আমরা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। ’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *