ঢাকা, শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৫:০৪ অপরাহ্ন
উখিয়া-টেকনাফের রাজারা ফের রাজপ্রাসাদে
সাখাওয়াত কাওসার, বাংলাদেশ প্রতিদিন ::
কক্সবাজারের হ্নীলা ইউনিয়নে ঢুকতে রাস্তার ঠিক মাথায় গোলাপি ও টিয়া রঙের রাজপ্রাসাদের মতো দুটি আলিশান দোতলা বাড়ি। বাড়ির নিরাপত্তায় রয়েছেন অন্তত পাঁচজন রক্ষী। একটু ভালো করে পরখ করলেই চোখে পড়বে নিরাপত্তা নি-িদ্র করতে বাড়ির চারপাশে লাগানো হয়েছে ডজনখানেক সিসিটিভি ক্যামেরা। বাড়ির ভিতরে ঢুকলে যে কারোরই মাথা চক্কর দিয়ে উঠবে।
রাজপ্রাসাদের মতো কারুকার্যশোভিত ফার্নিচার, মাথার ওপর ঝুলছে এক্সক্লুসিভ ঝাড়বাতি। বাড়ি দুটির মালিক নুরুল হুদা মেম্বার ও তার ভাই নুরুল কবির। তারা এলাকায় ‘ইয়াবা রাজা’ হিসেবে পরিচিত। মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হলে তারা আত্মসমর্পণ করেন।
তাদের রাজপ্রাসাদে আংশিক ভাঙচুর করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, দীর্ঘদিন কারাভোগের পর জামিনে বের হয়েই সংস্কার করে রাজপ্রাসাদে ফিরেছেন তারা। সদ্য সমাপ্ত ইউপি নির্বাচনে ফের মেম্বার নির্বাচিত হয়েছেন নুরুল হুদা। স্থানীয় সূত্রের দাবি, এবার তারা শুধু ইয়াবাতেই থেমে নেই, ক্রেজি ড্রাগস ক্রিস্টাল মেথ-আইসের দিকেও তাদের বিশেষ খেয়াল।
নুরুল হুদা মেম্বারের বড় ভাই নুর মোহাম্মদ মাদকবিরোধী অভিযানে ২০১৩ সালে ক্রসফায়ারে মারা যান।সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই মেরিন ড্রাইভে মেজর সিনহা মো. রাশেদ হত্যাকান্ডের পর নুরুল হুদার মতো সব মাদক ব্যবসায়ীর প্রতীক্ষার অবসান হয়।শুধু নুরুল হুদা মেম্বার নন, মাদকবিরোধী অভিযান ও আত্মসমর্পণের কারণে দীর্ঘদিন কারাগার ও আত্মগোপনে থাকার পর ফের ‘রাজপ্রাসাদে’ ফিরতে শুরু করেছেন টেকনাফের ইয়াবা ‘রাজা’রা। আবারও আলোঝলমল হয়ে উঠেছে এসব বাড়ি। ফিরেছে সেই জৌলুস।
তারা ফের জড়িয়ে গেছেন মাদক ব্যবসায়। তবে তারা নিরাপত্তার বিষয়ে আগের তুলনায় অনেক সতর্ক বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।টেকনাফ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আত্মসমর্পণকারী বাকি যারা এখনো কারাগারে আছেন তাদের জামিনের তদবির চলছে। বদি নিজেই তো তার ভাইসহ অন্যদের জামিনের জন্য তৎপর ছিলেন।যারা কারাগারের বাইরে ছিলেন তারা সবাই আত্মসমর্পণকারী সিন্ডিকেটেরই  সদস্য। তবে কারাগারে বসেও তাদের অনেকে ইয়াবা সিন্ডিকেট পরিচালনা করেছেন বলে আমরা জানতে পেরেছি। ’ টেকনাফ থানা থেকে ২-৩ কিলোমিটার দূরে নাজিরপাড়া। ওই এলাকায় ইয়াবা কারবারের টাকায় গড়ে তোলা হয়েছে সাতটি প্রাসাদোপম বাড়ি। বিলাসবহুল দুটি বাড়িতে থাকতেন নুরুল হক ভুট্টো ও তার ভাই নুর মোহাম্মদের পরিবার। তবে আদালতের নির্দেশে আলোচিত ইয়াবা কারবারি নুরুল হক ভুট্টোর দুটি দোতলা বাড়িসহ প্রায় ৩১ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করেছিল পুলিশ। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) মামলায় এ আদেশ দিয়েছিল আদালত। পুলিশ দুই তলা দুটি বাসভবন এবং ১১টি স্থানে থাকা প্রায় ২০ একর জমি জব্দ করেছিল। এর পর থেকে বাড়ি দুটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন এপিবিএন পুলিশ সদস্যরা। তবে এ বাড়ি দুটি টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি বর্তমানে কারাগারে আটক প্রদীপ সাহা টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করতেন। মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ হত্যা ঘটনার পর পুলিশ সদস্যরা ওই বাড়ি ছেড়ে চলে যান। তবে বাস্তবতা হলো, বর্তমানে ওই বাড়িতেই বসবাস করছেন ভুট্টো ও তার পরিবার। এর আগে ২০১৯ সালের মার্চে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নুরুল হক ভুট্টোর ভাই নুর মোহাম্মদ নিহত হন।২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ও ২০২০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ইয়াবা এবং অস্ত্র তুলে দিয়ে টেকনাফের প্রথম দফায় শীর্ষ ১০২ জন, দ্বিতীয় দফায় ২১ জন ইয়াবা ব্যবসায়ী আত্মসমর্পণ করলেও ভুট্টো আত্মসমর্পণ করেননি।র‌্যাব-১৫-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল খায়রুল ইসলাম সরকার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কে রাজা কিংবা রাজপ্রাসাদের সদস্য এটা আমার জানার বিষয় নয়। র‌্যাব অপরাধীকে খোঁজে। মাদকের বিষয়ে র‌্যাবের অবস্থান জিরো টলারেন্স। ’

টেকনাফ দক্ষিণ জালিয়াপাড়ার ইয়াবা কারবারি মো. জুবায়েরের তিন তলা বাড়িটির বাইরে থেকেই চোখ-ধাঁধানো। অথচ বাড়িটির আশপাশের সবকটিই ভাঙা বেড়ার ঘর, ওপরের ছাউনি পলিথিনের। এখানকার নিম্ন আয়ের সব মানুষই দিনমজুর অথবা জেলে। জুবায়ের একসময় ছিঁচকে চোর হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পরে ইয়াবা কারবারি হয়ে রাতারাতি কোটিপতি বনে যান।

সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জুবায়েরের বাড়ির ভিতরটা খুবই জৌলুসপূর্ণ রাজধানীতেও যা সচরাচর চোখে পড়ে না। এ বাড়ির কাছেই আরেকটি ডুপ্লেক্স বাড়ির মালিকের নাম মোজাম্মেল। যিনি একসময় পৌরসভার লামার বাজারে একটি পলিথিনের দোকানের কর্মচারী ছিলেন। অভিযান শুরুর পর তারা সবাই আত্মগোপনে চলে গিয়েছিলেন। টেকনাফের শুধু হ্নীলা কিংবা পৌরসভার জালিয়াপাড়া নয়, সদর ইউনিয়ন, সাবরাং ইউনিয়ন, হোয়াইক্যং ও বাহারছড়ায় গড়ে উঠেছে রাজপ্রাসাদের মতো অর্ধশতাধিক বাড়ি। এসব বাড়িতে ব্যবহার করা হয়েছে বিদেশি মারবেল পাথর, উন্নতমানের টাইলস ও ফিটিংস। বাড়িগুলোর বাইরের দৃশ্য এতটাই দৃষ্টিনন্দন যে চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। বাড়ির ভিতরের প্রতিটি কক্ষ সাজানো বিদেশি আসবাবপত্র ও সামগ্রী দিয়ে। স্থানীয়রা বলছেন, কয়েক বছর আগেও এদের কেউ ছিলেন বেকার, কৃষক, কেউ গরু ব্যবসায়ী, কেউ বাসের হেলপার, কেউবা বিক্রি করতেন পিঠা। কিন্তু ইয়াবা নামের আলাদিনের চেরাগের ছোঁয়ায় তাদের কপালে লেগেছে রাজটীকা। ২০১৮ সালের মে মাসে দেশজুড়ে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হলে এসব আলিশান বাড়ির দিকে নজর পড়ে প্রশাসনের। ওই বছরের অক্টোবরে এসব বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছিল প্রশাসন। রাতের আঁধারে অনেক প্রাসাদোপম বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়াও হয়েছিল। দেশের ১ নম্বর শীর্ষ ইয়াবা কারবারি হাজী সাইফুল করিমের বিলাসবহুল বাড়িটি বুলডোজার দিয়ে আংশিক ভেঙে ফেলা হয়। ২০১৯ সালের ২৬ জুন টেকনাফ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান জাফর আহমদের বাড়িতে গায়েবি হামলা ঘটে। টেকনাফ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জাফর আহমদ এবং তার তিন ছেলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারি। গত পাঁচ বছরে তিনি নির্মাণ করেছেন একটি বড় আয়তনের বাড়িসহ তিনটি বাড়ি এবং টেকনাফ শহরে একটি তিন তলা মার্কেট। অভিযান শুরুর পর তিনি আত্মগোপনে চলে যান। সিনহা হত্যাকান্ডের কিছুদিন পরই তিনি জামিন নিয়ে পুনরায় প্রকাশ্যে আসেন। টেকনাফ উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মৌলভী রফিক উদ্দিন ও তার ভাই বাহারছড়া ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান মৌলভী আজিজ উদ্দিনও তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারি। বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর পুরানপাড়া গ্রামে তারা নির্মাণ করেছেন দুটি বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স বাড়ি। মাদকবিরোধী অভিযানের সময় এ দুই ভাই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান। তারা দুই ভাই তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারি হলেও এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন। সাবরাং ইউনিয়নের নয়াপাড়ার সাবেক ইউপি সদস্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত মাদক কারবারি মাহমুদুর রহমানের বাড়িটি চোখ-ধাঁধানো। টেকনাফ উপজেলা ভূমি অফিসের পাশেই তিনি গড়ে তুলেছেন তিন তলা মার্কেট। সাবরাংয়ের মাদক ও সোনা চোরাকারবারি মাহমুদুল হক ওরফে মাদুরানও করেছেন বিলাসবহুল বাড়ি, করেছেন মার্কেট। মাদকবিরোধী অভিযানের সময় পালিয়ে আত্মগোপনে ছিলেন। মেজর সিনহা হত্যার পর আবারও এলাকায় এসে পুরোদমে মাদকের কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন। এ ছাড়া হোয়াইক্যং ইউনিয়নের নয়াবাজার সাতঘরিয়াপাড়ার সাবেক ইউপি সদস্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত মাদক কারবারি রাকিব আহমদের বাড়িটিও বিলাসবহুল। মাদকবিরোধী অভিযানের সময় আত্মগোপনে ছিলেন। তার পাশাপাশি হোয়াইক্যং সাতঘরিয়াপাড়ার রোহিঙ্গা মাদক কারবারি নুর হাফেজেরও বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে। টেকনাফ পৌর এলাকার শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী মোজাম্মেল হক, মং অং থেইন ওরফে মমচিং, নুরুল বশর নুরশাদ, মো. সালমান, মো. রাসেলের রয়েছে রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি। তাদের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে থানায় হত্যা, অস্ত্র ও মাদক ইয়াবার মামলা রয়েছে। সরেজমিনে এসব রাজপ্রাসাদের আশপাশ ঘুরে জানা গেছে, প্রতিটি ভবনেই নিরাপত্তার জন্য বসানো হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা। সাধারণ লোকজন এসব বাড়ির মালিকদের ‘ইয়াবা রাজা’ নামে ডাকেন। এই মাদক ব্যবসায়ীদের অনেকে ইয়াবার ‘বাবা’ বলেও ডাকেন। একই ধরনের ঘটনা আছে উখিয়ায়ও। ইয়াবা ব্যবসায়ী খোকা, মাহমুদুল হক ও বাবুল মিয়া রাস্তা থেকে এখন কোটিপতি। কয়েক বছর আগেও মাহমুদুল করিম খোকা নামের যুবকটি অন্যের মাইক্রোবাসে হেলপারি করে টানাটানির সংসারে দিনাতিপাত করতেন। কিন্তু এক-দুই বছরের ব্যবধানে বদলে গেছে তার জীবনযাত্রা। ইয়াবা পাচার করে তিনি বর্তমানে একাধিক প্রাইভেট কার, ডাম্পার ট্রাক, সিএনজি অটোরিকশা, মোটরসাইকেলের মালিক। গড়ে তুলেছেন নামে-বেনামে একাধিক সম্পদ। উখিয়া রেঞ্জের উখিয়া সদর বনবিটের রিজার্ভ বনভূমির টিলা কেটে ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন করে গড়ে তুলেছেন আধুনিক পাকা ভবন। বাড়ির চারদিকে লাগানো হয়েছে সিসি ক্যামেরা। বাইরে থেকে মনে হবে কোনো রাজপ্রাসাদ। উখিয়ার আরেক আলোচিত বাবুল মিয়া পাঁচ বছর আগেও ছিলেন গাড়ির হেলপার। তিনি এখন কোটিপতি। টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. হাফিজুর রহমান বলেন, ‘দেখুন, আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। তথাকথিত রাজপ্রাসাদগুলোতেও অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু সেখান থেকে কিছু উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তবে আমাদের নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। সম্প্রতি মাদক মামলায় বেশ কয়েকজন আসামি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *