ঢাকা, সোমবার ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:১৯ পূর্বাহ্ন
মিয়ানমারে নিবন্ধন ও নাগরিকত্বের সমাধান চান রোহিঙ্গারা
উখিয়া নিউজ ডেস্ক :

মিয়ানমারের মংডুর দক্ষিণ বাহারছড়া গ্রামে থাকতেন মো. আমিন (৪৮)। মাদ্রাসায় পড়াশোনা করা আমিনকে একদিন বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় মিয়ানমারের নাসাকা বাহিনী। পুরো পরিবারে নেমে আসে নির্যাতন, মানবিক দুর্যোগ। ধীরে ধীরে পুরো জনপদ যেন নির্যাতনের এক কারাগারে পরিণত হয়। ভয়ে পরিবার নিয়ে নদীপথে বাংলাদেশে চলে আসেন। এরপর থেকে কুতুপালং ক্যাম্পে আশ্রয় হয়। সেখানে হেড মাঝির দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

আমিন বলেন, ছোট্ট ত্রিপলের ছাউনিতে কীভাবে যে পাঁচটা বছর কেটে গেল টেরই পাইনি। মংডুতে মন পড়ে আছে। অবশ্যই সেখানে ফিরতে চাই। কিন্তু স্বাধীন নাগরিকের সুবিধা কে নিশ্চিত করবে?

আমিনের মতো এমন প্রশ্ন এখন লাখো রোহিঙ্গা নাগরিকের। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর কয়েক মাসের মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে বাংলাদেশে ছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা।

২৫ আগস্ট, রোহিঙ্গা ঢলের পাঁচ বছর পূর্ণ হলো আজ। নিজ দেশে ফিরে যেতে না পারার ব্যাকুলতা আজও লাখও রোহিঙ্গার মনে ভর করছে।

হতাশা ব্যক্ত করে তারা বলছেন, নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য মুহিবুল্লাহ (আততায়ীদের গুলিতে নিহত রোহিঙ্গা নেতা) দেশে-বিদেশে যেভাবে চেষ্টা করেছিলেন, তাতে তাদের মনে আশার সঞ্চার হয়েছিল। একদিন নিজ দেশে ফিরে যেতে পারবেন। বুক ভরে শ্বাস নিতে পারবেন। কিন্তু মুহিবুল্লাহ খুন হওয়ার মধ্য দিয়ে সেই স্বপ্নের ছেদ ঘটে।

তবে তারা বলছেন, নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবাসন পরিস্থিতি তৈরি হলে নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরতে চান তারা। চলাফেরার স্বাধীনতা, নিবন্ধন ও নাগরিকত্বের সমাধান দিতে হবে। দিতে হবে শিক্ষা, চিকিৎসাসেবা ও জীবিকা অর্জনের সুযোগ।

কিন্তু তারা কি ফিরতে পারবেন? দেশি-বিদেশি অনেক চেষ্টার পরও সে নিশ্চয়তার পরিবেশই তৈরি করা যায়নি গত পাঁচ বছরে।

রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন ‘জাতিগত নিধনের ধ্রুপদী’ উদাহরণ হিসেবে বর্ণনা করেছিল জাতিসংঘ৷ বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় ওঠার মধ্যে অনেকে একে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে সই করে মিয়ানমারের অং সান সু চি সরকার। ২০১৯ সালে দুই দফায় প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা শেষ পর্যন্ত ভেস্তে যায়৷

২০২১ সালের শুরুতে চীনের নেতৃত্বে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় আলোচনায় রোহিঙ্গাদের ফেরানোর প্রক্রিয়ায় আশার আলো দেখা যায়। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে দেশটিতে ক্ষমতার পটপরিবর্তনে সেটি থমকে যায়৷ ওই সময় বাংলাদেশ সরকার জানিয়েছিল, ছয় দফায় মোট আট লাখ রোহিঙ্গার তালিকা হস্তান্তর করা হয়েছে। যার মধ্যে মাত্র ৪২ হাজারের ভেরিফিকেশন সম্পন্ন করেছে মিয়ানমার৷ এর মধ্যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির টালমাটাল অবস্থা এবং করোনাভাইরাস মহামারির কারণে সেই আলোচনাও আর সামনে এগোয়নি৷

গত পাঁচ বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরাতে না পারার হতাশার কথা জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। তার ভাষায়, মিয়ানমারের নাগরিকদের এখনই নিজ দেশে ফেরত পাঠানো প্রয়োজন। কারণ, তারা নিজ দেশে ফেরার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন। আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্বার্থে মিয়ানমারের নাগরিকদের এখনই ফেরত পাঠানো প্রয়োজন।

গত ১৫ থেকে ১৯ আগস্ট কক্সবাজারের কুতুপালং, বালুখালি ক্যাম্পে বসবাস করা রোহিঙ্গা নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলে ঢাকা পোস্ট। কুতুপালং-এর একটি ক্যাম্পের হেড মাঝি মো. আমিন বলেন, ‘আমরা ফিরতে চাই। নিজ দেশে ফিরতে পারব— এমন স্বপ্নও বুনতে শুরু করেছিলাম। যার হাত ধরে আমাদের দেশে ফেরার স্বপ্ন শুরু, সেই মুহিবুল্লাকে হত্যা করা হলো নির্মমভাবে। তার পরিবারের ১১ সদস্যকে বিদেশে পাঠানো হলো।’

‘আমরা বাংলাদেশে থেকে মুসলিম ভাইদের আর কষ্ট দিতে চাই না। কিন্তু মানবিক বিপর্যয় থেকে বাঁচতে এখানে আসা। এখান থেকে মিয়ানমারে ফিরে স্বাধীনতা, অধিকার, রাষ্ট্রীয় সেবা থেকে যদি বঞ্চিত হই তাহলে তো আমাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। এসবের নিশ্চয়তা দিলেই আমরা ফিরে যাব।’

একই ধরনের বক্তব্য দেন আরেক রোহিঙ্গা নেতা মো. আনোয়ার। বলেন, আমরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ। কৃতজ্ঞ ইউএনএইচসিআরের প্রতি। আমাদের দুর্দিনে শেখ হাসিনা আশ্রয় দিয়েছেন। কক্সবাজারের মানুষ কষ্ট সইছে। আমরা আর এখানে থাকতে চাই না। দেশে ফিরতে চাই। কিন্তু ফেরার সেই পথ মসৃণ না হলে আমাদের সেখানে গিয়ে লাশ হতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *