ঢাকা, রবিবার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:২২ অপরাহ্ন
মুসকান বললেন একটুও ভয় পাইনি
ডেস্ক রিপোর্ট ::

মোটেও ভয় পাননি কর্ণাটকের কলেজছাত্রী মুসকান। উগ্র হিন্দুত্ববাদী কিছু ছাত্র কলেজ ক্যাম্পাসে তার পিছু নিয়েছিল। তারা স্লোগান দিচ্ছিল ‘জয় শ্রীরাম’ বলে। বোরকা পরা মুসকান তাদের দেখে বিন্দুমাত্রও বিচলিত হননি। উল্টো তাদের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে হাত তুলে ধরেছেন উচ্চে। স্লোগান দিয়েছেন- ‘আল্লাহু আকবর’ বলে। এর মধ্যদিয়ে তিনি মুসলিমদের শৌর্য, মর্যাদাকে উচ্চে তুলে ধরেছেন। আর সঙ্গে সঙ্গে সারা বিশ্বে তিনি হয়ে উঠেছেন ‘পোস্টার গার্ল’।

তার দিকে তেড়ে আসা ওই যুবকদের সঙ্গে তিনি বলেছেন, তাদেরকে একাই মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে মোটেও ভয় পাননি। হিজাব পরার আন্দোলন অব্যাহত রাখবেন তিনি। আরও বলেছেন, শুধু একটি পোশাকের কারণে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে।

ভারতের কর্ণাটকে মান্দিয়া প্রি-ইউনিভার্সিটি কলেজের ছাত্রী মুসকান দেখালেন অমিত সাহস। ওই রাজ্যে ক্ষমতাসীন বিজেপির বিপুল সংখ্যক সমর্থকের সামনে একাই জানিয়ে দিলেন তিনি মুসলিম। মাথা নত করার নয়। মুহূর্তে ওই তরুণীর ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়।

কর্ণাটকে হিজাব বনাম স্যাফ্রোন বা গেরুয়া স্কার্ফ নিয়ে উত্তেজনা তুঙ্গে। মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে মুসলিম ও বিজেপির সমর্থকরা। এক সপ্তাহের বেশি সংঘাতময় অবস্থার সৃষ্টি হলেও তা প্রশমনের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। উল্টো তা আরও শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। মঙ্গলবার বিক্ষোভ হয়েছে শিবামোগ্গা শহরে। সংঘর্ষ হয়েছে কিছু জায়গায়। তাতে বেশকিছু মানুষ আহত হয়েছেন। এর ফলে মুখ্যমন্ত্রী সেখানকার স্কুল বন্ধ করে দিয়েছেন তিন দিনের জন্য।

এ খবর দিয়ে অনলাইন এনডিটিভি বলছে, মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে উদুপি জেলার এমজিএম কলেজের গেটে দুটি গ্রুপ অবস্থান নিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ডাকা হয়। এ উত্তেজনার একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে এনডিটিভি, দূরদর্শন (ডিডি)। তাতে দেখা যায় নিজে স্কুটি চালিয়ে কলেজে পৌঁছেন এক মুসলিম তরুণী। বোরকায় তার শরীর আচ্ছাদিত। তিনি কলেজের পার্কিংয়ে স্কুটি পার্ক করেন। শান্তভাবে তা থেকে নেমে আসেন। ওদিকে আগে থেকেই ওত পেতে ছিলেন বিজেপির সমর্থক ছাত্ররা। তারা ওই যুবতীকে দেখেই গেরুয়া পতাকা উড়াতে উড়াতে তার দিকে এগিয়ে যায় এবং স্লোগান দেয় ‘জয় শ্রীরাম’।

বিপুল সংখ্যক ছাত্রের এমন বিক্ষোভ দেখে বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি ওই তরুণী শিক্ষার্থী। উল্টো তিনি তাদের সামনে দাঁড়িয়ে হাত উঁচু করে স্লোগান দেন- ‘আল্লাহু আকবর’। একবার দু’বার নয়। বেশ কয়েকবার এ স্লোগান দেন তিনি। বিজেপিপন্থিরা তার আরও কাছে চলে আসে। তিনি স্বাভাবিক গতিতে সামনে এগিয়ে যান। কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি হয় বিজেপিপন্থিদের সঙ্গে। এ সময় ওই তরুণীর সাক্ষাৎকার নিতে চেষ্টা করে মিডিয়া। সঙ্গে সঙ্গে আবার তাকে ঘিরে ধরে ওইসব ছাত্ররা। তারা গেরুয়া শাল উড়িয়ে, পতাকা দুলিয়ে নানা রকম স্লোগান দিতে থাকে।

এক পর্যায়ে দু’চারজন ব্যক্তিকে দেখা যায় ওই তরুণীকে উদ্ধার করছেন। তারপর তিনি চলে যান ক্লাসরুমের দিকে। এমন ঘটনায় সেখানে উত্তেজনা তুঙ্গে। হিজাব পরা ও স্যাফ্রোন বা গেরুয়া শাল পরা বিক্ষোভকারীদের মধ্যে উত্তেজনার পর হরিহরা এবং দাভেঙ্গেরে শহরে সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেখানে বিক্ষোভের সময় এক পক্ষ অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস এবং লাঠিচার্জ করে।

এসব ঘটনা থেকে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার মতো অবস্থায় পৌঁছালেও কর্ণাটকে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার এখনো নীরব। তারা অপেক্ষা করছে কর্ণাটক হাইকোর্টের একটি সিদ্ধান্তের জন্য। কলেজে হিজাব পরা নিয়ে বিধিনিষেধ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত চেয়ে উদুপির একটি সরকারি কলেজের পাঁচ যুবতী আদালতে পিটিশন করেছে। সেই পিটিশনের জবাবে আদালত কী বলে সেদিকে তাকিয়ে আছে সরকার।

পিটিশনের জবাবে কোনো সিদ্ধান্ত মঙ্গলবার ঘোষণা করেননি আদালত। তবে আদালত থেকে বলা হয়েছে, এই পিটিশনের আরও শুনানি হবে। এ সময়ে ছাত্রসমাজ ও জনগণকে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য অনুরোধ করেছে আদালত। জনগণের প্রজ্ঞা ও গুণাবলীর ওপর আদালতের পূর্ণ আস্থা রয়েছে। আদালত আশা করে জনগণ সেই চর্চা অব্যাহত রাখবে।

প্রথমে উদুপির একটি কলেজে হিজাব ইস্যুতে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে হিজাব পরার দাবিতে বিক্ষোভ করতে থাকেন মুসলিম ছাত্রীরা। পরে তা কর্ণাটকের অনেক কলেজে ছড়িয়ে পড়ে। পাল্টা বিক্ষোভ করে বিজেপিপন্থি শিক্ষার্থীরা। তারা বিজেপির  গেরুয়া শাল গলায় ঝুলিয়ে, পতাকা উড়িয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। এতে মুখোমুখি অবস্থানে চলে আসে উভয় পক্ষ। মঙ্গলবার তাতে সাম্প্রদায়িকতার রঙ লাগে। এক পক্ষ অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে অধিক আগ্রাসীভাবে সংঘাতে লিপ্ত হয়।

এদিন উদুপিতে একটি কলেজে বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থী বিক্ষোভ করেন। এর একপক্ষ হিজাবের সমর্থক। অন্য পক্ষ গেরুয়া স্কার্ফ পরার পক্ষে। এখান থেকেই এদিন উত্তেজনার শুরু। এনডিটিভি বলছে, উদুপির গভর্নমেন্ট গার্লস পিইউ কলেজে গত মাসে শুরু হয় হিজাব বিষয়ক প্রতিবাদ বিক্ষোভ। ওই সময় ৬ জন ছাত্রী অভিযোগ করেন, মাথায় স্কার্ফ পরে ক্লাস করায় তাদেরকে বাধা দেয়া হয়েছে। ক্লাসরুমে মুসলিম বালিকাদের হিজাব পরার বিরোধিতা করে উদুপি এবং চিক্কামাগালুরুর উগ্র ডানপন্থিরা।

শুরুটা এখান থেকে হলেও বিক্ষোভ আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে উদুপি এবং অন্যান্য স্থানে। এ অবস্থায় রাজ্য সরকার শনিবার এমন পোশাক নিষিদ্ধ করে, যা সমতার ক্ষেত্রে, সম্মানের ক্ষেত্রে এবং জনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। তবে প্রশাসনিক কমিটি ওই কলেজের জন্য কোনো নির্দিষ্ট পোশাক কোড নির্বাচন করেনি।

ঘটনার পরে মুসকান এনডিটিভিকে বলেছেন, আমি মোটেও ভয় পাইনি। আমি কলেজে প্রবেশ করছিলাম। আমি ছিলাম বোরকা পরা। শুধু এ কারণে তারা আমার পিছু নেয়। কলেজে প্রবেশ করতে দিচ্ছিল না। তারা চিৎকার করে জয় শ্রীরাম স্লোগান দেয়। আমিও সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে বলি আল্লাহু আকবর। আমাকে সমর্থন করেছেন প্রিন্সিপাল ও লেকচারাররা। তারা আমাকে রক্ষা করেছেন। মুসকান আরও বলেন, তাকে ধাওয়া করেছিল যে দলটি তাদের শতকরা প্রায় ১০ ভাগ কলেজছাত্র। বাকিরা মনে হয়েছে বহিরাগত। মুসকানের ভাষায়- আমাদের অগ্রাধিকার শিক্ষা গ্রহণ করা। কিন্তু তারা চাইছে আমাদের শিক্ষাকে ধ্বংস করে দিতে।

মুসকান বলেন, এই আন্দোলন শুরু হয়েছে গত সপ্তাহে। আমরা সব সময় বোরকা ও হিজাব পরি। ক্লাসে আমি বোরকা খুলে রাখি। তবে হিজাব পরে থাকি। কারণ হিজাব হলো আমার পবিত্রতার অংশ। এ নিয়ে প্রিন্সিপাল আমাদেরকে কিছুই বলেননি কখনো। আমাদের হিজাব নিয়ে বিরোধিতা শুরু করেছে বহিরাগতরা। তাই আমাদেরকে বোরকা না নিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছেন প্রিন্সিপাল। আমরা হিজাবের দাবিতে অব্যাহতভাবে বিক্ষোভ করছি। একজন মুসলিম মেয়ের জন্য হিজাব একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

মুসকান ওই কলেজের দ্বিতীয় বর্ষ কমার্সের ছাত্রী। তাকে এখন সমর্থন করছেন হিন্দু বন্ধুবান্ধবীরাও। মুসকান বলেন, আমি নিরাপদ বোধ করছি। আমাকে সবাই বলেছেন, ‘আমরা আছি তোমাদের সঙ্গে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *