সদ্যবিদায়ী সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেছেন, সেনাপ্রধান নিয়োগ দেওয়ার এখতিয়ার সরকারের। তাঁকে কোনো রাজনৈতিক বিবেচনায় এই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
ডয়চে ভেলে ‘খালেদ মুহিউদ্দিন জানতে চায়’ শীর্ষক ইউটিউব টকশোতে গত ২৪ ডিসেম্বর তিনি এ কথা বলেন। জার্মানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগের প্রধান খালেদ মুহিউদ্দিনের সঙ্গে তাঁর এই আলাপচারিতায় উঠে আসে আলোচিত এই জেনারেল সম্পর্কিত নানা দিক।
আলোচনার শুরুতেই উঠে আসে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে জেনারেল আজিজের ভিসা বাতিলের প্রসঙ্গটি। খালেদ মুহিউদ্দিন বিষয়টি নিয়ে তাঁর কাছে সরাসরি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের কতগুলো আইনে বলা হয়েছে, কারও ভিসা যদি যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষ বাতিল করে, সেটি তাঁকে নোটিশ করতে হবে। আমাকে কি তাঁরা জানিয়েছে? আমি যখন ভিসার জন্য আবেদন করেছিলাম, তখন আমার স্থায়ী ঠিকানা, যোগাযোগ করার নম্বর, ই-মেইল ঠিকানা দেওয়া হয়েছে। অন্য দশজন সাধারণ মানুষের মতো আমি নই, যে আমাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কি আমার ভিসা বাতিল করা হয়েছে? তা কিন্তু করা হয়নি। আমি বিভিন্ন মাধ্যমে খোঁজখবর নিয়েছি। আমার ভিসা বাতিল করা হয়েছে এমন কিছু পাওয়া যায়নি।’
এ সম্পর্কিত খবর তাঁরও নজরে পড়েছে উল্লেখ করে জেনারেল আজিজ বলেন, ‘কোনো সোর্স উল্লেখ না করে তারা একটা খবর দিয়েছে। এমন কোনো নোটিশ তো আসেনি আমার কাছে।’
আলোচনায় উঠে আসে, এমন খবরের পর জেনারেল আজিজ যুক্তরাষ্ট্রে যেতে চেষ্টা করেছিলেন কি না। সম্পূরক এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, প্রয়োজন না পড়ায় তিনি এমন কোনো চেষ্টা করেননি। একই সঙ্গে এ-ও জানান, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতেই তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছেন। এ অবস্থায় কেউ কিছু প্রচার করল বলে তিনি প্রয়োজন ছাড়া কেন সেই দেশে যাওয়ার চেষ্টা করবেন?
অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে থাকা এই জেনারেলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় আলোচনায়। তাঁর কয়েক শ কোটি টাকা আছে উল্লেখ করে এ সম্পর্কে জানতে চাইলে সদ্যবিদায়ী এই সেনাপ্রধান বলেন, ‘শত শত কোটি টাকা তো দূরে থাক। সামান্য কিছু টাকার সূত্র দিয়ে দেন, যা দিয়ে বাকি জীবনটা একটু স্বাচ্ছন্দ্যে কাটাতে পারি। মানুষ প্রমাণ ছাড়া অনেক কথা বলে। নিশ্চয়ই তার পেছনে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য থাকে। এ ধরনের কথায় আমি খুব ব্যথিত হই। ৩৯ বছর সামরিক বাহিনীতে চাকরি করেছি। যখনই সময় পাই আমার কোর্সমেটদের সঙ্গে গলফ খেলতে যাই। অনেক বন্ধুবান্ধব আছে, তারা আসে, তাদের সঙ্গে সময় কাটাই। আমি পোস্ট ডক্টরেট করছি, সেটা নিয়ে সময় কাটাই।’
আলোচনায় উঠে আসে জেনারেল আজিজের ব্যক্তিগত সহাকারীর দুর্নীতির দায়ে পদচ্যুতির প্রসঙ্গটি। জেনারেল আজিজ জানান, তিনি বিষয়টি সম্পর্কে অবসরে যাওয়ার পর শুনেছেন। তিনি বলেন, ‘সিরিয়াস কিছু হলে তাঁকে সার্ভিস থেকে সরিয়ে দেওয়া হতো। সে ক্ষেত্রে অনেককেই জেল বা বরখাস্ত করা হয়। কিন্তু তাঁকে নরমাল অবসরে পাঠানো হয়েছে।’
এই পর্যায়ে উঠে আসে তাঁর সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার বিষয়টি। জেনারেল আজিজ রাজনৈতিক বিবেচনায় সেনাপ্রধান হয়েছেন কি না, জানতে চাইলে সদ্যবিদায়ী এই সেনাপ্রধান বলেন, ‘সেনাপ্রধান নিয়োগ দেওয়া সরকারের এখতিয়ার। ২০১৮ সালে এই আইন হয়েছে। তার আগে জেএসআইয়ের সুপারিশ অনুযায়ী চাকরি, অবসর—এগুলো হতো এবং সে অনুযায়ী সরকারের সুপারিশ অনুযায়ী মহামান্য রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিয়ে থাকেন। এখানে সাধারণ যে বিষয়গুলো বিবেচনায় আনা হয়ে থাকে, সেটা হলো কমান্ডো এক্সপেরিয়েন্স, ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট অ্যাবিলিটি, সার্ভিস প্রোফাইল, বিভিন্ন কোর্সে পারফরম্যান্স। আপনি যেটা বললেন, সিনিয়রদের ডিঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাকে যখন নিয়োগ দেওয়া হয়, তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে আমিসহ তিনজন লেফটেন্যান্ট জেনারেল ছিলেন। এই তিনজন থেকে যেকোনো একজনকে সেনাপ্রধান করতে পারবে। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা বেশি ছিল। আমি ১০টা মিলিটারি কোর্স করেছি। এর মধ্যে আটটিতে আমি সেরা পাঁচে ছিলাম। একটাতে নবম। অন্যটাতে অসুস্থ ছিলাম। সেটাতে খারাপ হয়েছে। কিছু কিছু বাদ দিলে সেনাবাহিনীর প্রায় সব ক্ষেত্রে আমার কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে। এখন আসেন কমান্ডের বিষয়ে। আমি বিজিবির মতো একটা বাহিনী কমান্ড করেছি, যা একটি প্যারামিলিটারি বাহিনী, যেটা সেনাবাহিনীর পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তা-ও চার বছর। বাকি দুজনের একজন আনসার ও ভিডিপি কমান্ড করেছেন। আমার মনে হয় যে কেউ একমত হবেন যে, আনসার ও ভিডিপি কমান্ডের চেয়ে বিজিবি কমান্ড করাটা মোর চ্যালেঞ্জিং। সুতরাং অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে আমাকে সেনাপ্রধান করা হয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া হয়নি।’
ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এই সাক্ষাৎকারে অবধারিতভাবে উঠে আসে কাতারভিত্তিক সম্প্রচারমাধ্যম আল-জাজিরার ডকুমেন্টারি ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার ম্যান’-এর বিষয়টি। এই তথ্যচিত্রের কী প্রভাব পড়েছিল এবং জেনারেল আজিজ সত্যিই তাঁর ভাইদের বাবা-মায়ের নাম বদলে পাসপোর্ট করা বা সে ক্ষেত্রে তাঁর সরাসরি কোনো সংশ্লিষ্টতা বা তাঁর পদ-পদবির প্রভাব ছিল কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সত্য-মিথ্যা যাই থাক, এ রকম প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর বিব্রত হওয়াই স্বাভাবিক। প্রচারিত হওয়ার পর আমি বিব্রতবোধ করছি। সে সময় আমি সরকারি নিমন্ত্রণে আমেরিকায় ছিলাম। তবে আল-জাজিরার দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আমি সেনাপ্রধান থাকাকালীন আমার ভাই বা আত্মীয়কে বিজিবি বা সেনাবাহিনীর কোনো সরঞ্জাম কেনার কন্ট্রাক্ট দিয়েছি কি না, আমি সে ব্যাপারে চ্যালেঞ্জ করছি। কেউ এ ধরনের প্রমাণ দিক। যারা এসব কথা বলছে; সম্পূর্ণ মিথ্যা। বাংলাদেশের কত লক্ষ লক্ষ লোক দেশের বাইরে থাকেন, তাঁরা কি তাঁদের সঠিক পরিচয় ব্যবহার করছেন’
উঠে আসে ২০১৮ সালের নির্বাচন প্রসঙ্গ। আওয়ামী লীগের পক্ষে ফল নিয়ে আসার জন্য সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করার অভিযোগের কথা উল্লেখ করে সাক্ষাৎকারে সে সময় তাঁর ভূমিকার কথা জানতে চাওয়া হয়। জবাবে জেনারেল আজিজ বলেন, ‘সেনাবাহিনী একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী। এখানে চেইন অব কমান্ড চলে। যখন কোনো নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে মোতায়েন করা হয়, তখন সবাই ইলেকশন কমিশনের আন্ডারে চলে যাই। একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন করার জন্য সবকিছু করতে পারে নির্বাচন কমিশন। সেখানে কার কী দায়িত্ব, একেবারে স্পেসিফিক বলা আছে। আমাদের দায়িত্ব সম্পর্কে বলা আছে, সবগুলো জেলায় যাব, প্রয়োজন হলে উপজেলায় যাব। নির্বাচনে ম্যাজিস্ট্রেট বা যাঁরা আছেন, আমাদের নির্দেশ দিলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য আমরা দ্রুতই সেখানে চলে যেতে পারি। সে সমস্ত জায়গায় আমরা অবস্থান নিয়ে থাকি। সেখানে চাইলেই সেনাবাহিনীর যা কিছু করার এখতিয়ার নেই।’
সেই নির্বাচনকে ‘অসাধারণ’ আখ্যা দিয়ে তাঁর করা মন্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে আজিজ আহমেদ বলেন, ‘২০১৮ সালের নির্বাচন দেখেন এবং অন্যান্য সময়ের নির্বাচন দেখেন, কোন সময় বেশি ক্যাজুয়ালটি হয়েছে? ভোট কেমন হয়েছে, সেটা দেখার দায়িত্ব আমার না। আমাদের দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলার সিচুয়েশন ঠিক রাখা। আমার যে বক্তব্যটা ছিল, সেটা নির্বাচন কমিশনের কথা ছিল।’
আলোচনায় জেনারেল আজিজ আহমেদ ও তাঁর কোর্সমেট লেফটেন্যান্ট কর্নেল শহীদের মধ্যে হওয়া ফোনালাপ ফাঁসের প্রসঙ্গ এলে তিনি তা খারিজ করে দেন। বলেন, ‘আগামী জুনের ২৫ তারিখের পর থেকে আমার সম্পূর্ণ রিটায়ারমেন্ট শুরু হবে। তখন এসব প্রোপাগান্ডার বিষয়ে আমি ব্যবস্থা নেব। যেকোনো ব্যক্তির ৩০ মিনিটের একটি অডিও সফটওয়্যার দিয়ে যেকোনো কথা যদি ক্লোন করতে চান, সেটি করতে পারেন।’
Leave a Reply