কক্সবাজারে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। বৃষ্টিতে পাহাড়ি ঢল ও জোয়ারের পানিতে নতুন করে আরও বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বন্যা, পাহাড় ধস ও সাপের ছোবলে শিশুসহ ৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন ।
এর মধ্যে -চকরিয়া ও পেকুয়ায় ৩ শিশুসহ ৬ জন, রামুতে ১ শিশু এবং উখিয়ার রোহিঙ্গা শিবিরে মা-মেয়েসহ -২ জন নিহত হয়েছেন।
মঙ্গলবার (৮ আগস্ট) দুপুর পর্যন্ত জেলার সাতটি উপজেলার কমপক্ষে ৪৫টি ইউনিয়নের সাড়ে চার লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। পানির কারণে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কে যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।
আবহাওয়া অফিসের কক্সবাজার আঞ্চলিক কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষণ কর্মকর্তা দুলাল চন্দ্র দাশ জানিয়েছেন, সোমবার সকাল ৬টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ১৬৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে ১৭ মিলিমিটার। আগামী আরও তিন দিন বৃষ্টি অব্যাহত থাকবে। এতে পাহাড় ধসের আশঙ্কাও রয়েছে বলে জানান তিনি।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কক্সবাজারের প্লাবিত ইউনিয়নের সংখ্যা ছিল ৩১টি। যা মঙ্গলবার এসে ৪৫ ইউনিয়নে প্লাবিত হওয়ার তথ্য মিলছে। যেখানে ছয় হাজারের বেশি পরিবারের সাড়ে চার লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী রয়েছে।
জেলায় সবেচেয়ে বেশি প্লাবিত এলাকা চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলায়। যে দুই উপজেলার একটি পৌরসভাসহ ২৫টি ইউনিয়ন প্লাবিত হওয়ার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। যেখানে অন্তত আড়াই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও লোকজন জানিয়েছেন, পাহাড়ি ঢলের প্রবেশমুখ সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়ন ও কাকারা ইউনিয়ন চার থেকে পাঁচ ফুট পানির নিচে তলিয়ে আছে। জিদ্দাবাজার-কাকারা-মানিকপুর সড়কের কয়েকটি অংশের ওপর দিয়ে মাতামুহুরি নদী থেকে উপচে আসা ঢলের পানি প্রবাহিত হওয়ায় বসতঘরগুলো পানির নিচে তলিয়ে গেছে। বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। শুকনো খাবার ছাড়া রান্নার কোন ব্যবস্থা নেই গত দুইদিন ধরে।
চকরিয়ার লক্ষ্যারচর, কৈয়ারবিল, বরইতলী, হারবাং, সাহারবিল, চিরিঙ্গা, পূর্ব বড় ভেওলা, বিএমচর, পশ্চিম বড় ভেওলা, ঢেমুশিয়া, কোনাখালী, ফাঁসিয়াখালী, বদরখালী, ডুলাহাজারা, খুটাখালী এবং পেকুয়া উপজেলার পেকুয়া সদর ইউনিয়ন, উজানটিয়া, মগনামা, রাজাখালী, টৈটং, শিলখালী, বারবাকিয়া ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
পেকুয়ার সদর ইউনিয়নের মেহেরনামার বেড়িবাঁধটি ভেঙে উজান থেকে নেমে আসা বন্যার পানি লোকালয়ে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। এসব ইউনিয়নের নিচু গ্রামগুলোতেই পানি উঠেছে অধিক।
চকরিয়া পৌরসভার মেয়র আলমগীর চৌধুরী বলেন, অতি বৃষ্টির কারণে পৌরসভার অধিকাংশ ওয়ার্ড পানির নিচে তলিয়ে গেছে। স্ব-স্ব ওয়ার্ডের কাউন্সিলররা পানি যাতে দ্রুত নিচের দিকে নেমে যায়, সেজন্য কাজ করছে। এছাড়াও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ১ নম্বর বেঁড়িবাঁধটি রক্ষার জন্য বালির বস্তা ফেলা হচ্ছে।
সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম ও কাকারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাহাব উদ্দিন জানান, আমাদের ইউনিয়নগুলো মাতামুহুরি নদীর সঙ্গে লাগোয়া। এজন্য পাহাড় থেকে নেমে ঢলের পানি আগে আঘাত আনে এসব ইউনিয়নগুলোতে। এই দুই ইউনিয়নে অধিকাংশ ঘর পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে। গত দুইদিন ধরে তাদের রান্নার কাজও বন্ধ। শুধু শুকনো খাবার খেয়ে রয়েছে।
শীলখালী ইউপি চেয়ারম্যান কামাল হোসেন বলেন, টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে অনেক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। তারা এখন পানিবন্দী হয়ে আছে লোকজন।
টইটং ইউপির চেয়ারম্যান জাহেদ চৌধুরী জানান, টানা বৃষ্টির পানিতে আমার ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে অনেক পরিবার পানিবন্দী হয়ে আছে।
পেকুয়া সদর ইউপি চেয়ারম্যান বাহাদুর শাহ জানান, দ্রুত সময়ের মধ্যে ভাঙা অংশ মেরামত করা না হলে আরও ভয়াবহ হবে পেকুয়ার জন্য। দ্রুত মেরামতের ব্যবস্থা নেয়া জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পূর্বিতা চাকমা জানান, সকাল থেকে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন সরজমিনে পরিদর্শন করেছি। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে অসংখ্য মানুষ। তাদের জন্য শুকনো খাবারের ব্যবস্থার জন্য ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বারদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এছাড়া রামু উপজেলার চার ইউনিয়ন নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। মিঠাছড়ি, খুনিয়াপালং, রশিদনগর ও জোয়ারিয়ানালা-এ চার ইউনিয়নের বাঁকখালী নদী সংলগ্ন গ্রামের শতাধিক পরিবার পানিবন্দী হয়েছে। ঈদগাঁও উপজেলার ঈদগাঁও, জালালাবাদ, পোকখালী, ইসলামাবাদ ইউনিয়ন, কক্সবাজার সদরের পিএমখালী, খুরুশকুল, পৌরসভার কয়েকটি ওয়ার্ড, কুতুবদিয়ার ছয়টি ইউনিয়ন, মহেশখালীর তিনটি ইউনিয়ন প্লাবিত হওয়ার তথ্য জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
এদিকে, টানা বর্ষণের ফলে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের কয়েকটি উপজেলায় চলমান প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১০ পদাতিক ডিভিশন আগে থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে।
উখিয়া-টেকনাফ এলাকায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দুর্যোগ মোকাবিলার লক্ষ্যে সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী দল কার্যক্রম শুরু করেছে।
১০ পদাতিক ডিভিশন কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি নিয়মিত সংবাদ সংগ্রহ ও বিভিন্ন তথ্যের জন্য রামু সেনানিবাসে দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য কন্ট্রোলরুম স্থাপন করা হয়েছে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, গত কয়েক দিন ধরে প্রবল বর্ষণ ও পূর্ণিমার উচ্চ জোয়ার অব্যাহত রয়েছে। উচ্চ জোয়ারের কারণে এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এখন যে তথ্য রয়েছে তাতে কুতুবদিয়ায় ৭০০ পরিবার, পেকুয়াতে ১০ হাজার পরিবার, মহেশখালীতে ৫০০ পরিবার, চকরিয়ায় ৫০ হাজার পরিবার, কক্সবাজার সদরে এক হাজার পরিবার, ঈদগাঁও উপজেলায় ১৫০ পরিবার পানিবন্দী রয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। প্রতিটি উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা মাঠে রয়েছে। তারা বোট নিয়ে পানিবন্দী মানুষের ঘরে ঘরে যাচ্ছে এবং তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসছে।
Leave a Reply