ঢাকা, সোমবার ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:২১ পূর্বাহ্ন
‘রোহিঙ্গাদের কারণে আমরা এখন সংখ্যালঘু’
শফিউল্লাহ শফি, কক্সবাজার

রাতে ঘুম হয় না, আমার মন কাঁদে। কারণ আমার এই মাতৃভূমির কী হবে। আমাদের ঘরবাড়ি, পরিবার-পরিজন ও উখিয়া-টেকনাফবাসীর কী অবস্থা হবে। আমরা কী নিজেদের রক্ষা করতে পারব! ভবিষ্যতে অনাগত কারণে এই রোহিঙ্গারা যদি আমাদের ওপর ভর করে তাহলে আল্লাহ ছাড়া বাঁচানোর কেউ থাকবে না।’

২৫ আগস্ট বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের পাঁচ বছর পূর্তি নিয়ে উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ এবং শিক্ষাবিদ অধ্যাপক হামিদুল হক চৌধুরী  কথাগুলো বলেন। তিনি কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি।

রোহিঙ্গা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা এখন সংখ্যালঘু! কারণ উখিয়া-টেকনাফ দুই উপজেলায় জনগণ ৫ থেকে ৬ লাখ। আর এখন নতুন-পুরাতন মিলে রোহিঙ্গা রয়েছে ১২ লাখের বেশি। তাতে বোঝা যায় আমরা সংখ্যালঘু। তাছাড়া প্রতিনিয়ত রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ছেড়ে বাইরে স্থানীয়দের জমিতে দোকানসহ নানা স্থাপনা নির্মাণের চেষ্টা চালায়। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে বর্তমানে সর্বক্ষেত্রে তাদের বিচরণ।

উদাহরণ তুলে তিনি বলেন, কয়েক বছর পূর্বে টেকনাফের নয়াপাড়া ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে দোকান নির্মাণের চেষ্টা করে ছৈয়দ আহমদসহ ১০-১২ জন রোহিঙ্গা। এ সময় পুলিশ বাধা দিলে ফাঁড়ির আইসি ইন্সপেক্টর কবির হোসেনকে বেধড়ক মারধর করে মাথা ফাটিয়ে দেয় রোহিঙ্গারা। তাহলে আর কী বোঝার বাকি থাকে। আশ্রয়ের কিছু দিন যেতে না যেতেই এ ঘটনা ঘটিয়েছিল; যার ধারাবাহিকতা এখনো আছে।

অধ্যাপক হামিদুল হকের মতো হতাশার কথা ব্যক্ত করেন উপজেলা যুবলীগের সভাপতি মুজিবুল হক আজাদ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, রোহিঙ্গাদের কাঁটাতারের মধ্যে রাখা গেলে কিছুটা আশঙ্কামুক্ত হতাম। কিন্তু বর্তমানে জনতার স্রোতে তারা মিশে যাচ্ছে। এই ক্যান্সারে একদিন এ দেশের মানুষ যন্ত্রণায় কাঁদবে। আশা করি না এই রোহিঙ্গা আবার ফিরে যাবে। কারণ ১৯৭৮ থেকে আজ পর্যন্ত যারা এসেছে তারা এখনো বহাল তবিয়তে আছে। তাদের এদেশে প্রবেশের বর্ষপূর্তি আসলে কিছুটা প্রত্যাবাসনের কথা শুনি। পরে তা জনমনে হারিয়ে যায়; কিন্তু প্রতিবছর ধারাবাহিকভাবে পালন হতেই আছে বর্ষপূর্তি।

কুতুপালং, বালুখালী ঘুরে একাধিক বাংলাদেশি লোকজনের সঙ্গে কথা হয়। তাদের দাবি, মিয়ানমারে সেনা ও উগ্র মগের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের কাছে এদেশের লোকজন সংখ্যালঘু হয়ে দুর্ভোগময় জীবন কাটাচ্ছেন। তারা জানান, নিত্যপণ্যের বাজারে দামের ঊর্ধ্বগতি, যানবাহনের ভাড়া বৃদ্ধি, পড়ালেখায় বিঘ্ন, পরিবেশ বিপর্যয়সহ নানা রোগবালাইয়ের কাছে জিম্মি এখন এ অঞ্চলের মানুষ। ফলে সীমান্ত উপজেলা দুটির স্থানীয় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ছন্দপতন ঘটেছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায়।

স্থানীয় লোকজনের অভিযোগের ভিত্তিতে কুতুপালং, উখিয়া ও কোটবাজার এলাকার বাজার ঘুরে দেখা যায়, দ্রব্যমূল্য চরম ঊর্ধ্বমূখী। তবে ক্যাম্পের ভেতরে যে দোকানগুলো রয়েছে তার অবস্থা আরও নাজুক। চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে সব ধরনের নিত্যপণ্য।

স্থানীয় বাজার জরিপে দেখা যায়, প্রতি কেজি আলু ৪৫ টাকা, করলা ৬০, শসা ৫০, টমেটো ১৬০, তিত করলা ৬০, ঢেঁড়স ৭০ টাকা, কাঁচামরিচ ২২০, বরবটি ৫০, কচুর ছরা ৬০, পটল ৫০, মিষ্টি কুমরা ৬০ ও পাটশাক ১০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

উখিয়ার কুতুপালং এলাকার স্থানীয় মেম্বার হেলাল উদ্দিন বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন খুবই জরুরি। জেলার অন্যান্য উপজেলা থেকে উখিয়া-টেকনাফের মানুষ সব দিক দিয়ে কষ্টে আছে। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের কারণে এই অঞ্চলে সর্বদায় নিত্যপণ্যের দামও বেশি; যা প্রতিনিয়ত স্থানীয়রা ভোগান্তির শিকার হয়ে যাচ্ছেন।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, রোহিঙ্গাদের জন্য সরকার যে তিন হাজার একর জমি নির্ধারণ করেছে তার মধ্যে মধুরছড়ার পাহাড়ও রয়েছে। অনেক আগে থেকেই স্থানীয় বাসিন্দারা (বাংলাদেশি) সরকারি বনভূমি দখল করে এই পাহাড়ে বসতি গড়ে তুলেছিল। কিন্তু রোহিঙ্গাদের বসতির জন্য এখন স্থানীয়রা প্রায় হারিয়েই গেছে।

মধুরছড়ার পাহাড়ে বসবাসরত আনোয়ার হোসেন বলেন, এই মধুরছড়ায় হরেকরকম কৃষিচাষ করে আমি স্বাবলম্বী ছিলাম। ছিল গরু ও মহিষ। রোহিঙ্গাদের বসতি সব কেড়ে নিয়েছে। আমার পাঁচ একর জমি ছিল। এখন সবখানে রোহিঙ্গাদের বসতি। এই বসতি গড়ার কারণে আমার ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে গেছে।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা জানান, নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের কারণে উখিয়া টেকনাফের স্থানীয় লোকজন অনেক স্বার্থ ত্যাগ করেছেন। এটি অস্বীকারের কিছু নেই। তবে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ও সরকারের একটি মানবিক দিক ছিল। তাই বর্তমান সরকার সব কিছু মাথায় রেখে নানা সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের পাশাপাশি প্রত্যাবাসনের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *