মিয়ানমারের যুদ্ধ-পরিস্থিতিতে স্থবির হয়ে পড়েছে কক্সবাজারের সীমান্ত বাণিজ্য। জেলার টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে মিয়ানমার থেকে প্রতি মাসে আড়াই শতাধিক ট্রলারে করে বিভিন্ন ধরনের পণ্যসামগ্রী আনা-নেওয়া হতো স্বাভাবিক সময়ে। সেখানে গত এক মাস ধরে এসেছে দৈনিক দুই থেকে তিনটি ট্রলার। আয়রোজগার হারিয়ে বিপাকে পড়েছেন স্থানীয় জেলে, শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা। আর রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। এসব তথ্য জানিয়েছেন টেকনাফ স্থলবন্দর পরিচালনা প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ল্যান্ড পোর্ট লিমিটেডের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপক মেজর (অব.) সৈয়দ আনসার মোহাম্মদ কাউসার ও স্থানীয় ব্যবসায়ী নেতারা। স্বাধীনতাকামী আরাকান বিদ্রোহীদের অবস্থান সম্প্রতি শক্তিশালী হওয়ায় তাদের সঙ্গে মিয়ানমার সেনাদের যুদ্ধের কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
টেকনাফ স্থলবন্দরের শ্রমিকনেতা আলী আজগর বলেন, এ বন্দরে প্রায় এক হাজার শ্রমিক কাজ করেন। অনেক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। স্বাভাবিক সময়ে বন্দরে দৈনিক ৬০ থেকে ৯০টির মতো ট্রাক লোড-আনলোড হয়। সম্প্রতি ওপারে যুদ্ধ-পরিস্থিতির কারণে এখন উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। কোনো কোনো দিন একটি ট্রাকও বন্দর ছেড়ে যাচ্ছে না।
ট্রাকচালক আমির হোসেন তার সাক্ষী। তিনি বলেন, আগে মাসে তিন থেকে পাঁচটি ভাড়া নিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম যেতেন। কিন্তু গত ১৭ দিনে একটিও ভাড়া পাননি। তিনি বলেন, ‘শুধু আমি না। এ রকম আরও প্রায় দেড়-দুইশ ট্রাক রয়েছে। তারা সবাই অলস সময় পার করছেন।’
আমদানিকারক মোহাম্মদ উমর ফারুক আদা, নারকেল, শুঁটকি, সুপারি ও ছোলা আমদানি করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদানি-রপ্তানিতে ধস নেমেছে। আকিয়াব বন্দরে কিনে রাখা শত শত মণ মাল মজুদ রয়েছে। এগুলো আনতে না পারলে ব্যবসায়ীদের অনেক ক্ষতি হবে।’
স্বাভাবিক সময়ে টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে প্রতি মাসে প্রায় ১০০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয় বলে জানান এখানকার শুল্ক কর্মকর্তা এ এস এম মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, যুদ্ধের কারণে কয়েক মাস ধরে তা ৩০ থেকে ৪০ কোটিতে নেমেছে। কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি বন্ধ থাকলেও মিয়ানমার থেকে দৈনিক দুই থেকে তিনটি ট্রলার আসছে।
টেকনাফ থেকে ছয় শতাধিক ট্রলারে করে নাফ নদী দিয়ে গভীর সাগরে যান ১১ হাজারের বেশি জেলে। যুদ্ধের কারণে তাদের জীবনযাত্রায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। টেকনাফের কায়ুখালী, সাবরাং, শাহপরীরদ্বীপ থেকে এসব ট্রলার সাগরে মাছ ধরতে যেত, যা এখন বন্ধ রয়েছে। ট্রলারমালিক মোহাম্মদ হোসেন বলেন, গত ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে একটি ট্রলারও সাগরে যেতে পারেনি। প্রশাসনের পক্ষে নিষেধাজ্ঞা থাকা এবং নাফ নদীর ওপারে গোলাগুলির শব্দে জেলেরা ভীত। নাফ নদীতেও মাছ ধরা বন্ধ আছে একই কারণে।
বিপাকে রয়েছেন চিংড়ি চাষিরাও। টেকনাফের উনচিপ্রাং সীমান্তে নাফ নদীর এপারে রমজান আলীর রয়েছে ৬০ একর চিংড়িঘের। ১০ ফেব্রুয়ারির পর থেকে আতঙ্কে রয়েছেন তিনি। রমজান বলেন, ‘বর্গা নিয়ে ৬০ একর জমিতে চিংড়ি ঘের করছি। বার্ষিক বর্গা দিতে হয় ৯ লাখ টাকা। চাষের সঙ্গে জড়িত ২০ জন শ্রমিক। কর্মচারীরাও আতঙ্কিত, আমরাও আতঙ্কিত। এ রকম পরিস্থিতি চলতে থাকলে চরম লোকসান গুনতে হবে।’ একই এলাকার চিংড়ি চাষি শাহীন শাহজাহানসহ অন্যদেরও একই অবস্থা।
সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন জানান, টেকনাফের হোয়াইক্যং এবং হ্নীলা ইউনিয়নের বেড়িবাঁধের আশপাশে ২ হাজার ৪০০ হেক্টর জায়গাজুড়ে ৪০০ চিংড়িঘের রয়েছে। সেখানে আট শতাধিক চাষি জড়িত। মিয়ানমারে সংঘাতের কারণে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
গত প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে আরাকান বিদ্রোহী ও মিয়ানমার সেনাদের যুদ্ধ চললেও কয়েক দিন হলো তা টেকনাফের কাছে নাফ নদীর ওপারে মিয়ানমারের মংডু শহরে তীব্র হয়েছে। সেখান থেকে সময়-অসময় বিস্ফোরণে শব্দ ও মাঝেমধ্যে গুলি, মর্টার শেল এসে পড়ছে বাংলাদেশে। তবে শনিবার দুপুর থেকে রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত কোনো বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়নি।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিজিবি ও কোস্ট গার্ড সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, মিয়ানমারের সংঘাতময় পরিস্থিতির কারণে বিজিবি ও কোস্ট গার্ডের টহল বাড়ানো হয়েছে। সীমান্তে বসবাসরত মানুষকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।’ পরিস্থিতি কবে নাগাদ স্বাভাবিক হবে তার কোনো নিশ্চয়তা কোনো পক্ষ এখনও দিতে পারছে না। ফলে স্থানীয় জেলে ও ব্যবসায়ীদের জীবন-জীবিকা এখনও অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে বলে তারা জানিয়েছেন।
Leave a Reply