ঢাকা, শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৪:০৬ পূর্বাহ্ন
গোলাগুলি মিয়ানমারের ‘নতুন ফাঁদ’
সমকাল ::

সব শিশুর পরনে হলুদ স্কুল ড্রেস। বিদ্যায়তনের সবুজ ঘাসের চত্বরে কেউ খেলছিল গোল্লাছুট, কেউ কানামাছি। পাহাড়ি এলাকায় আশ্বিনের দুপুরে মাথার ওপর তপ্ত রোদ। রোববার, ঘড়ির কাঁটায় তখন ২টা ১০ মিনিট। হঠাৎ বিকট আওয়াজ। কয়েকবার এমন শব্দে কেঁপে উঠল আশপাশ। শিশুরা দৌড়ে মাঠ ছেড়ে চলে গেল বিদ্যালয়ের ভেতরে। এই দৃশ্য বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমের একেবারের সীমান্তঘেঁষা ভাজাবনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের।

স্কুুলটির অদূরে সীমান্তের কাঁটাতার, যা আলাদা করেছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে। বিদ্যালয়ের ঠিক পেছনেই আছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) চৌকি। সীমান্তের ওপারে রাখাইন রাজ্যে এক মাস ধরে চলছে গোলাগুলি। গতকালও কয়েক দফা গোলাগুলি হয়েছে। সীমান্তে মিয়ানমারের এমন আচরণকে দেশটির জান্তা সরকারের ‘নতুন ফাঁদ’ হিসেবে দেখছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। গোলার পাশাপাশি তাদের উদ্বেগ মিয়ানমারের কূটচাল ঘিরে। আর শূন্যরেখায় বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের সাফ কথা- প্রত্যাবাসন ঠেকাতেই নিজেদের ভেতরের বিরোধ বাইরে ঠেলে দেওয়ার অপচেষ্টা করছে মিয়ানমার। রোহিঙ্গা ফেরত না নিয়ে উল্টো নতুন করে ঝামেলা বাড়াচ্ছে।

ভাজাবনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সৈয়দ-উর রহমান বললেন, সীমান্তের ওপারে গোলাগুলির ঘটনায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি কাজ করছে। ২৮ আগস্ট স্কুুল থেকে ৪০০ গজ দূরে হামিদ-সুলতানের বাড়ির আঙিনায় মর্টার শেল এসে পড়ে। প্রায় প্রতিদিন থেমে থেমে বিস্ম্ফোরণের বিকট শব্দ শোনা যাচ্ছে। এই পরিস্থিতির কারণে এক মাস ধরে ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী গড়ে প্রতিদিন অনুপস্থিত। আবার সীমান্তের ওপার থেকে গোলাগুলির শব্দ পেলেই অনেক অভিভাবক শিশুদের বাড়ি নিয়ে যেতে স্কুুলে এসে হাজির হন।

ভাজাবনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী সৈয়দ করিম বলে, ‘ধুম-ধুম শব্দ হলেই ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে। রাতেও অনেক সময় বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে যায়।’

সীমান্ত এলাকা ঘুরে দেখতে গেলে সেখানকার বাসিন্দাদের উৎকণ্ঠা তাদেরই বয়ানে উঠে আসে। বয়োবৃদ্ধদের মধ্যে আতঙ্কের ছাপ তুলনামূলক কম। তবে কম বয়সের নারী-শিশুদের মনোজগতে মিয়ানমারের হঠকারী ঘটনার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সীমান্তঘেঁষা অনেক পরিবার নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য তাদের নিকটাত্মীয়দের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। আবার শূন্যরেখার রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ অন্য রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তাদের স্বজনের কাছে যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।

৭২ বছর বয়সী নুরুল ইসলামের বাড়ি ঘুমধুমের তুমব্রুর ফকিরাকোনা এলাকায়। তিনি বলছিলেন, ‘আঁরা শান্তি চাই; বর্মারা চায় যুদ্ধ। ইতারা যুগ যুগ ধরি ঝামেলা গড়ের।’ গোনপাড়া ২ নম্বর ওয়ার্ডের জাফর আলম বলেন, ‘গতকাল সকাল ৮টার পর কয়েক দফায় বিকট শব্দ কানে আসে। লোকজন যাতে আতঙ্কিত না হয়, এ জন্য কয়েক দিন আগে এলাকায় মাইকিং করা হয়েছিল। তার পরও শিশুরা তো ভয় পাবেই।’

সরকারিভাবে পাওয়া ঘরের আঙিনায় বসে প্রতিবেশী নারী রশিদা বেগমের সঙ্গে গল্প করছিলেন ঘুমধুমের বাসিন্দা আমিনা খাতুন। কয়েক দিনের দৃশ্যপটের ব্যাপারে জানতে চাইলে আমিনা বলেন, ‘এত শব্দ হলে কে না ভয় পাবে! শিশুরা ঘুমের মধ্যে চমকে ওঠে। অনেকে মাঠে কাজে যেতেও ভয় পান।’

তুমব্রু বাজারের চিত্র কিছুটা ভিন্ন। দোকানে দোকানে জটলা বেঁধে অনেকে গল্পে মাতেন। গ্রাম্য বাজার ঘিরে জড়ো হওয়া মানুষের মুখে মুখে একই কাহিনি। ওই বাজারের মুদি দোকানি রাসেল জানান, মিয়ানমারের গোলাগুলির ঘটনার পর থেকে তুমব্রুর নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সীমান্তের অধিকাংশ মানুষ নিরীহ। তারা শান্তিতে থাকতে চায়। তবে কয়েক দিন ধরে অনেকের মনে শান্তি নেই। নিরাপত্তা নিয়ে সবাই ভাবছে। শুনলাম, শূন্যরেখায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ অন্য ক্যাম্পে তাদের পরিচিতদের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছে।

তুমব্রুর কাছে ‘নো ম্যান্স ল্যান্ড’। ২০১৭ সাল থেকে সেখানে স্থাপিত ক্যাম্পে বাস করছে ৪ হাজার ২০০ রোহিঙ্গা। মিয়ানমারের জান্তা সরকার চায় এই রোহিঙ্গা বাংলাদেশের ভেতরে কোনো ক্যাম্পে আশ্রয় নিক। শূন্য পয়েন্টে বসবাসকারী রোহিঙ্গা জান্নাতুইল্যা বলেন, ‘আমরা নিজ দেশে ফিরতে চাই। তবে ফিরতে দিচ্ছে না মিয়ানমার। ওপারে অনেক রোহিঙ্গাকে নিজ দেশের ক্যাম্পে শরণার্থী হিসেবে রাখা হয়েছে।’

ঘুমধুম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর আজিজ জানান, ঘুমধুমে বাঙালি, পাহাড়িসহ প্রায় ২৪ হাজার লোকের বাস। তাদের মধ্যে সীমান্ত-সংলগ্ন এলাকায় আছে ১০ হাজারের মতো। আরও ২ হাজারের মতো মানুষ বাস করে একেবারে সীমান্ত ঘেঁষে। গতকাল নাইক্ষ্যংছড়িতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে সীমান্ত এলাকার পরিস্থিতি নিয়ে একটি বৈঠক হয়েছে। সেখানে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে- পরিস্থিতি আরও নাজুক হলে সীমান্তের ৩০০ মিটার ভেতরের বাংলাদেশি নাগরিকদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হতে পারে। তবে তাদের সরানোর পর কোথায় রাখা হবে, এ বিষয়টি চূড়ান্ত হয়নি।

চেয়ারম্যান আরও জানান, মিয়ানমার নিজেদের ভেতরে নতুন সমস্যা তৈরি করে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনকে আরও দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করছে। বিশ্ব সম্প্রদায়কে তারা বোঝাবে- মিয়ানমার এখন নিজেদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা মোকাবিলা করছে। এই মুহূর্তে রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। গোলাগুলির ঘটনা তাদের নতুন ফাঁদ।

এদিকে সীমান্ত এলাকায় বিজিবির টহল জোরদার করা হয়েছে। জরুরি কোনো কারণ ছাড়া কাউকে সীমান্তে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। পুরো পরিস্থিতির ওপর কড়া নজর রাখছে বিজিবি। বিজিবি সদরদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন্স) লে. কর্নেল ফয়জুর রহমান বলেন, সীমান্তে টহল বাড়ানো হয়েছে। গোয়েন্দা কার্যক্রমও বেড়েছে। নতুনভাবে মিয়ানমারের একজন নাগরিকও যাতে আমাদের দেশে ঢুকতে না পারে, সে জন্য নিরবচ্ছিন্ন নজরদারি রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, বিজিবির পক্ষ থেকে মিয়ানমারের সঙ্গে পতাকা বৈঠকের আহ্বান জানানো হয়েছে। তাদের পক্ষ থেকে এখনও আমরা সাড়া পাইনি।

সীমান্ত পরিস্থিতির ওপর নজর রাখেন এমন একাধিক বিশেষজ্ঞ জানান, খুব কম সময়ই মিয়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণ করেছে। দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকা প্রায় ৩০০ কিলোমিটার। ‘টাটমাড’ নামে স্থানীয়ভাবে পরিচিত মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী ৭৫ বছর ধরে দেশটির কোথাও না কোথাও নিজ জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। এ ছাড়া বর্তমানে মিয়ানমারভিত্তিক সংগঠন আরাকান আর্মির সঙ্গে দেশটির জান্তা সরকারের এক ধরনের টানাপোড়েন চলছে। যদিও এক সময় আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমার সরকারের ভালো সম্পর্ক ছিল। কয়েক মাস ধরে দূরত্ব তৈরি হলে তাদের টার্গেট করে হামলা করছে মিয়ানমার। আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর যুদ্ধের উত্তাপ ছড়াচ্ছে সীমান্তের এপারে বান্দরবানের থানচি ও নাইক্ষ্যংছড়িতেও।

নিরাপত্তা বিশ্নেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ  বলেন, মিয়ানমার তাদের অভ্যন্তরে নিজ দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সেখান থেকে নিক্ষেপ করা গোলা এখানে পড়লে সেটা উদ্বেগের। এটার দায় মিয়ানমারকে নিতে হবে। এসব ঘটনা আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইনের চরম লঙ্ঘন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *