দেশের জনপ্রিয় পর্যটন শহর কক্সবাজার পর্যন্ত নির্মাণাধীন রেলপথ নিয়ে চলছে আলোচনা সমালোচনা। রেলপথে ঢাকা থেকে কক্সবাজার যাবার আশায় অপেক্ষায় থাকা অনেকেই নতুন রেললাইনের ভগ্নদশা দেখে হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন। প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের এ মেগা প্রকল্প কতটা জলবায়ুর বান্ধব, টেকসই আর পরিকল্পিত হচ্ছে তা নিয়েও।
আগস্ট মাসের শুরুতে চট্টগ্রাম অঞ্চলে রেকর্ড বৃষ্টিপাতের কারণে পাহাড়ি ঢলে রেললাইনটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা যায়, রেললাইনটি সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাতকানিয়ার তেমুহনী এলাকায় আধা কিলোমিটার জুড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত অংশে রেললাইন উঁচু-নিচু হয়ে আছে। স্লিপারের মাঝে পাথর সরে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্ত। সংস্কার ছাড়া এ পথে রেল চলাচল শুরু করা একেবারেই অসম্ভব।
সামান্য ক্ষতি?
চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত যাবার পথে নতুন রেললাইনের এ ক্ষতিকে নগণ্য হিসেবে দেখছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। বলা হচ্ছে, রেলপথের এই ক্ষতি মেরামতে দু’সপ্তাহ কাজ করতে হবে। প্রকল্প পরিচালকের দাবি করছেন পরিকল্পনা অনুযায়ী অক্টোবর মাসেই এর উদ্বোধন এবং ট্রেন চলাচল শুরু করা হবে।
‘যে ক্ষতি হয়েছে এটা যদি আমাদের চালু কোনো রেললাইন হতো তাহলে আমরা একদিনে ঠিক করে ফেলতে পারতাম। আমার যে ক্ষতিটা হয়েছে এই ক্ষতির পরিমাণ তো খুব বেশি না। নগণ্য এ ক্ষতির পরিমাণ।’
‘আমার পুরো প্রজেক্টের যে ব্যয় ওই তুলনায় ক্ষতি তো এক-দেড় কোটি টাকা। এটা সামান্য। একটা নরমাল মেইনটেনেন্সে আমাদের লাগে। এ ধরনের ক্ষতি আমাদের যেগুলো চলমান রেলওয়ে আছে এগুলোতেও বন্যা হলে হয়,’ বলেন প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান।
রেললাইনের ক্ষতিকে সামান্য দাবি করা হলেও এটিকে মোটেও খাটো করে দেখতে চান না বিশেষজ্ঞরা। এবারের অভিজ্ঞতা থেকে ক্ষতিগ্রস্ত রেললাইনটি সংস্কার বা মেরামতের স্থায়ী সমাধানে নজর দেওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
ড. আইনুন নিশাত বলেন, ‘যেটা ঘটে গেছে সেটা কেন ঘটেছে সেটা হিসাব-নিকাশ করা হোক। জাতীয় কমিটি হওয়া উচিত একটা।’
‘আমাদের দেশের কালচার হচ্ছে ভেঙেছে ওইটাকেই আবার পুনর্নির্মাণ করা। কেন ভেঙেছে এই কারণটা খুঁজে বের করে ভবিষ্যতে যাতে এই ভুলের মধ্যে না পড়ি সেটা ঠিক করতে হবে।’
এখন কীভাবে সমস্যার সমাধান হবে এ প্রশ্নে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘সমাধান তো অনেকগুলোই আছে। কিন্তু এর আগে তো এখানে এ রকম বৃষ্টিপাত হয়নি। বিশেষজ্ঞরা যে মতামত দেয় সে মতামত আমরা সাদরে গ্রহণ করবো।’
চট্টগ্রামের দোহাজারি থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নির্মাণাধীন রেললাইনের দৈর্ঘ্য ১০২ কিলোমিটার। এ প্রকল্পটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এ অবকাঠামো বর্তমান সরকারের একটি অগ্রাধিকার প্রকল্প।
আগামী অক্টোবর মাসে উদ্বোধনের পর রেল চলাচল শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে। নির্মাণ শেষ হবার আগেই পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় পূর্ব নির্ধারিত সময়ে ট্রেন চলাচল শুরু হবে কী না তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
রেললাইন কেন ক্ষতিগ্রস্ত?
স্থানীয় বাসিন্দারা মনে করেন, নতুন এই রেললাইনে যে বাঁধ দেওয়া হয়েছে সেখান থেকে পাহাড়ি ঢলের পানি বেরিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কালভার্ট ও ব্রিজ নির্মাণ করা হয়নি। রেললাইনের সাথে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তরা বলছেন, সেখানে আরও বেশি কালভার্ট রাখার প্রয়োজন ছিল। যেগুলো তৈরি হয়েছে সেগুলো আরও প্রশস্ত করে বানানোর প্রয়োজন ছিল বলেও মনে করেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
স্থানীয় একজন কৃষক আবুল কালাম রেললাইনের সঙ্গে সমান্তরাল সড়ক বিভাগের রাস্তা দেখিয়ে বলেন, একই দূরত্বে সড়কের চেয়ে রেললাইনে কম কালভার্ট দেওয়া হয়েছে। যেগুলো দেওয়া হয়েছে সেগুলোর রাস্তার চেয়ে কম প্রশস্ত। রাস্তার যে দূরত্বে চারটি বড় কালভার্ট দেখা যায়, তার বিপরীতে একই দূরত্বে রেলপথে দুটি কালভার্ট চোখে পড়ে।
এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য নকশা ও পরিকল্পনায় স্থানীয় জনসাধারণের অভিজ্ঞতা ও মতামতকে যথাযথ বিবেচনা করা হয়নি। এমনটাই মনে করেন নাগরিক সংগঠন পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহ-সভাপতি এবং প্রকৌশলী সুভাষ চন্দ্র বড়ুয়া। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, প্রকল্পে ডিজাইনের সময় স্থানীয় জনসাধারণের মতামত নেওয়া খুবই জরুরি।
স্থানীয়রা যারা বলছে যে, এখানে কালভার্ট কম হয়েছে, ওপেনিং কম হয়েছে, সেটা নিয়ে তাদের সঙ্গে বসা দরকার ছিল। এখানে পিপলস পার্টিসিপেশন ছাড়া কিন্তু প্রজেক্ট ডিজাইন করা সম্ভব না। এইটাই আমাদের একটা বড় গলদ।’
‘আমরা মনে করি আপনি ইঞ্জিনিয়ার না, আপনার সাথে কী আলাপ করব? নো। আপনি প্রত্যেক দিন ওই জায়গা দিয়ে হাঁটছেন। কোথায় কী প্রবলেম সেটা আমার থেকে বেশি জানেন। ওরাতো আর আর আমাদের এখানে থাকে না। ওরা আমাদের নিত্যদিনের সমস্যা কী সেটাতো জানে না,’ বলেন সুভাষ চন্দ্র বড়ুয়া।
তবে কালভার্টের সংখ্যা কমানো হয়নি বরং বাড়ানো হয়েছে বলে দাবি করেন প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান। তিনি জানান, কক্সবাজার রেল লাইনের একশ কিলোমিটারে ১৭৩টি কালভার্ট, ৩৮টি ব্রিজ তৈরি হয়েছে। একশ কিলোমিটার রেললাইনে সাড়ে চার কিলোমিটার জায়গা পানি নিষ্কাশনের জন্য ওপেন রাখা হয়েছে।
রেললাইনের ক্ষতির কারণ হিসেবে রেকর্ড বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলকেই দায়ী করছেন প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, ‘দুইদিনে আটশ মিলিমিটার বৃষ্টি তো আগে কখনো হয়নি। এখন যদি আমাদের ক্লাইমেটের অদ্ভুত আচরণের জন্য হয়, এই জিনিসগুলোতো আমাদের আগে জানা ছিল না। এভাবে তো আমরা কালভার্টের সংখ্যা করিনি। আরও দুটো কালভার্ট যদি থাকত তাহলে কি বন্যা হতো না?’
‘রোড থেকে আমাদের রেললাইন অনেক উপরে। রোড তো পুরোটাই ডুবে গিয়েছিল। পুরো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। সেই তুলনায় আমার তো মাত্র ৪৫০ মিটার বা আধা কিলোমিটার অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলো। কক্সবাজারের দিকে কিছুই হয়নি,’ বলেন প্রকল্প পরিচালক।
Leave a Reply