ঢাকা, শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৩:৩৭ অপরাহ্ন
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হত্যাকান্ডের মুলে মাদক, অস্ত্র ও স্বর্ণ চোরাচালান
ড. মাহবুব হাসান ::

স্বার্থ ও লোভ মানুষকে কতটা নগ্ন-নিষ্ঠুর করে ফেলে এর ভূরি ভূরি উদাহরণ পৃথিবীতে আছে। এ রকম লোভ আর স্বার্থের জেরে প্রতিদিনই হাজারো মানুষ হত্যার শিকার হচ্ছে। আমরা নিজেদের প্রাণীকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করি। কিন্তু আসলে কাজ করি নিকৃষ্ট। মানুষের মতো হিংস্র ও বিধ্বংসী আর কোনো ইতর প্রাণীর আচরণে নেই। সামাজিক জীবনে যেমন ওই ইতরতা আছে, তেমনি পরিবার জীবনেও আছে লোভ ও ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের নৃশংসতা। আবার জাতিগত চিন্তা থেকে জাত-জাতীয়তাবাদের উগ্রতার ফলস্বরূপ আমরা নৃশংস হত্যাযজ্ঞের শিকার হতে দেখছি। এরই সর্বশেষ হত্যাযজ্ঞের উদাহরণ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী। ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সামরিক সরকার ও তার বাহিনী রোহিঙ্গাদের উৎখাত করে তাদের সহায়-সম্পদ ও জমি-জমা দখল করতে আবারও গণহত্যা শুরু করে। তা আজও চলমান।

এর আগে সত্তরের দশকেও একবার বার্মা (মিয়ানমারের আগের নাম) সরকার রোহিঙ্গা মুসলিমবিরোধী ক্লিনজিং অপারেশন চালিয়েছিল। ওই সময়ও বাঁচার জন্য রোহিঙ্গারা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে ঢুকেছিল। এর পর ১৯৯১ ও ২০১৭ সালে চলে মূলত গণহত্যা আর উচ্ছেদ অভিযান এবং বাড়িঘর ও জমিজমা দখল। এই অভিযানে ঘরছাড়া, দেশছাড়া ও হত্যার শিকার হয় নিরীহ কৃষি উৎপাদক রোহিঙ্গা যারা বা যাদের পূর্বপুরুষরা ৩০০ বছরের আগে থেকে রোসাঙ্গে কিংবা আজকের নাম আরাকানে বাস করছে। অর্থাৎ রোহিঙ্গারা আরাকানের আদিবাসিন্দা। কিন্তু মিয়ানমারের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সামরিক ও বেসামরিক লোকজন ‘দখলের লোভ’ আর জাতীয়তাবাদী সংকীর্ণ ও নৃশংস নৃতাত্ত্বিক চেতনারই প্রকাশ ঘটিয়েছে রোহিঙ্গা হত্যার মাধ্যমে। তারা মনে করে, রোহিঙ্গারা মূলত বাংলাদেশের মানুষ। এ কারণে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়নি ওই দেশে।

২০১৭ সালের পর বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার টেকনাফ ও উখিয়ার পাহাড়ি এলাকায় তাদের জন্য ৩৪টি আশ্রয় শিবির করে দেয় বাংলাদেশ। ওই শরণার্থীদের সর্বাত্মক সাহায্য দিচ্ছে সরকার। এর সঙ্গে আছে জাতিসংঘের খাদ্য ও ত্রাণ সংস্থা ইউএনএইচসিআর। ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা ওইসব শিবিরে বাস করছে দেশে প্রত্যাবসানের লক্ষ্যে।

রোহিঙ্গা মানবাধিকারবিষয়ক এক সংস্থার চেয়ারম্যান (আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস) মুহিবুল্লাহ হত্যার শিকার হন গত ২৯ সেপ্টেম্বর। তিনি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কাজ করছিলেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে। তিনি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে প্রত্যাবাসন নিয়ে মোটিভেশনাল কাজে বেশ এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু তাকে হত্যার পর ওই কাজটি থেমে গেছে বলেই মনে হয়। তবে আশ্রয়শিবিরের অনেক মাদ্রাসাশিক্ষক ও ছাত্রও উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন এ কাজে। ওই রকম একটি মাদ্রাসায় সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়ে সাতজনকে হত্যা করেছে ২১ অক্টোবর। মুহিবুল্লাহ হত্যার ২৩ দিন পর হত্যার শিকার হলো ৭ রোহিঙ্গা। উখিয়ার শরণার্থী আশ্রয়শিবিরে এ হত্যার কারণ একটিই- তার নাম লোভ আর স্বার্থ। হত্যাকারীরা তাদের সন্ত্রাসী কাজ, মাদক, অস্ত্র ও স্বর্ণ চোরাচালনের অবৈধ কাজ চালাতেই বিরোধীদের হত্যা করছে।

এটা হচ্ছে সাধারণ চোখে দেখা ও বোঝার সিদ্ধান্ত। কিন্তু একবারও কেউ বলছেন না, ওই ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে ১১ লাখ মানুষের মধ্যে ১২-১৪টি সন্ত্রাসী গ্রুপের জন্ম হলো কীভাবে? তারা তো জীবনধারণের জন্য সবই পাচ্ছিল। তা হলে কেন সন্ত্রাসী গ্রুপ সৃষ্টি হলো? এর পেছনের রহস্য কী? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেলেই অব্যাহতভাবে হত্যার মোটিভ জানা ও বোঝা যাবে।

কক্সবাজরের টেকনাফ যেমন বৈধ আমদানি-রপ্তানির পথ, তেমনি অবৈধ আমদানি-রপ্তানিরও। বহু আগে থেকেই মাদক চোরাচালানের পথ হিসেবে ওই পথটি ব্যবহৃত হচ্ছে। মিয়ানমারের শান প্রদেশের গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গালের হেরোইন বাংলাদেশে ঢোকে ওই পথে। এখন হেরোইন উৎপাদনের চেয়ে ক্রিস্টাল মেথ বা আইস ও ইয়াবা ট্যাবলেট উৎপাদিত হয় শানে বেশি। কারণ এর উৎপাদন খরচ কম ও লাভ তুলনামূলকভাবে বেশি। ওই মাদক পাচারের রুট হিসেবে বাংলাদেশ ব্যবহৃত হয়ে আসছে দীর্ঘকাল ধরে। আর এর সঙ্গে জড়িত সীমান্তের কতিপয় মানুষ। তাদের রাজনৈতিক পরিচয় ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে যেমন আছে, তেমনি বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও আছে। মূলত তারাই অবৈধ মাদকপাচারকারী। তারাই শরণার্থী শিবিরের কতিপয় উগ্র মানুষকে পাচারের কাছে লাগায় এবং তাদের হাতে তুলে দিয়েছে অস্ত্র। তারাই মুহিবুল্লাহ এবং পরে ৭ মাদ্রাসাশিক্ষক ও ছাত্রকে হত্যা করেছে। তারা কারা? শরণার্থী শিবিরের মানুষের কাছে তারা কারও অচেনা নয়। তাদের ভাই কিংবা সন্তান তারা। কিন্তু কী করে তারা ওই রকম মাদকপাচারের সঙ্গে যুক্ত হলো? কী করে তারা অবৈধ অস্ত্রের জোগান পাচ্ছে? কী করে তারা অপরাধ করেও নিরাপদে পালিয়ে থাকছে?

আশ্রয়শিবিরের বাসিন্দারা চারদিকে কাঁটাতারের ঘেরে বন্দি অবস্থায় বাস করে। ওইসব শিবিরে নিরাপত্তা রক্ষা করছে এপিবিএন, পুলিশ, র‌্যাব ও বাইরে আছে বিজিবি। তার পরও হত্যাকারীরা বাস করছে সেখানেই। তারা হত্যাকা-ের পর নির্বিঘেœ নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে পারছে। কী করে তা সম্ভব হচ্ছে? এর ব্যাখ্যায় উঠে আসছে টেকনাফ কক্সবাজারের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সংশ্লিষ্টতা। দেশের সীমান্ত এলাকায় যারা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত, তাদের ৯০ শতাংশই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের লোক। যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে, তখন তাদেরই হাতে চলে যায় চোরাচালানের মূল নেটওয়ার্ক। আর তারাই সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সঙ্গে যোগসাজশ করে দেয়। তারাই সন্ত্রাসীদের লালন-পালন করে ক্রিস্টাল মেথ বা আইস নামক ভয়ঙ্কর মাদকের ব্যবসায়। ভিকটিমদের কী লাভ হলো দেশ ছেড়ে অন্য দেশে পাড়ি দিয়ে? তারা তো তাদের জীবনই বাঁচাতে পারল না। তাদের জীবন বাঁচিয়ে রেখে দেশে প্রত্যাবাসনের যে কাজটি বাংলাদেশ সরকার করছিল, তা তো ভেস্তে যেতে বসেছে।

এসব হত্যার দায় চাপানো হচ্ছে আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির (আরসা) ওপর। সে আর্মির নাম হচ্ছে সালভেশন বা রোহিঙ্গা কিংবা আরাকান উদ্ধার, তারা কেন প্রত্যাবাসনপ্রত্যাশী রোহিঙ্গাদের হত্যা করবে? এর মানে হলো- যারা মাদক, স্বর্ণ, অস্ত্রের পাচার নির্বিঘœ রাখতে চায়; তারাই এসব হত্যার নীলনকশাকারক ও তা বাস্তবায়নকারী। ২-৩ স্তর নিরাপত্তা বেষ্টনী থাকার পর যখন হত্যাকা-গুলো হচ্ছে, তখন এটি প্রমাণ হয়ে যায়- ‘শর্ষের মধ্যেই ভূত রয়েছে’।

রোহিঙ্গা শিবিরে সন্ত্রাসীদের শিকড়-বাকড় উৎপাটন তেমন কষ্টকর হবে না- যদি চোরাচালানচক্রের মূল হোতাদের থামানো যায়। তারা এতটাই ডেসপারেট যে, প্রশাসনকে কেয়ার করে না। রাজনীতি তাদের ঢাল হলেও তারা মূলত সন্ত্রাসী ও দেশের ক্ষতির জন্য যা তারা চায়, সেটিই করতে পারে। তদের নেই দেশপ্রেম বা পার্টিপ্রেম কিংবা ওই রকম কিছু। কোনো রকম মায়া-মহব্বত নেই মানুষের প্রতি। দেশের যুবসমাজ ধ্বংস হলেও তাদের লোভ কেবল অর্থবিত্তের এবং সেটিই তাদের পাচারকাজের মূলে।

নিশ্চয়ই বিজ্ঞ রাজনৈতিক অভিভাবকরা উপলব্ধি করতে পারছেন কেমন করে শরণার্থী শিবিরে সন্ত্রাসী গ্রুপ সৃষ্টি হয়, কেমন করে তারা মুহিবুল্লাহকে হত্যার পর সালভেশন আর্মির ওপর দোষ চাপায় এবং তারা নির্বিঘেœ পার পেয়ে যায়। এর কারণও নিহিত মিয়ানমারের রাজনৈতিক ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে। আরাকান সালভেশন আর্মির চরিত্র হননের মধ্যে নিহিত আছে তাদের রাজনৈতিক আকাক্সক্ষা দমন ও নস্যাৎ করা। তাদেরই এজেন্টরা কুতুপালং শিবিরে বলেছে, মুহিবুল্লাহ হত্যা আরসার কাজ। আরসার নামে সন্ত্রাসীরা ওই পরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যাযজ্ঞ চালায়।

 

 

আমাদের সময় 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *