ঢাকা, শনিবার ২০ জুলাই ২০২৪, ১২:২২ অপরাহ্ন
‘মৌলবাদীদের কারণেই কক্সবাজার সৈকতের উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না’
জাগো নিউজ ::

রাশেদ খান মেনন। সভাপতি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। সাবেক মন্ত্রী, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। দেশের পর্যটনশিল্পের সমস্যা, সম্ভাবনা ও নিরাপত্তার প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হয়েছেন জাগো নিউজের।

পর্যটনশিল্পের অপার সম্ভাবনা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, আন্তঃমন্ত্রণালয়ের দ্বন্দ্বের কারণেই এ খাতের অগ্রগতি হচ্ছে না। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু

জাগো নিউজ: বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারির দু’বছর পার করছে বিশ্ব। এর মধ্যেও ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ছেন ভ্রমণপিপাসুরা। দেশের পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনা-ভবিষ্যৎ নিয়ে কী বলবেন?

রাশেদ খান মেনন: বাংলাদেশ হচ্ছে অপার সম্ভাবনার দেশ। এমন সম্ভাবনার দেশ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আছে বলে আমি মনে করি না। কিন্তু আমরা আসলে সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারিনি।

দেশের পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনাও ব্যাপক। এখানে যে কয়টি পর্যটন স্পট রয়েছে, তার সব কয়টিই আকর্ষণীয় এবং সম্ভাবনাময়।

আমরা যদি নিরাপত্তা, যাতায়াত সুবিধা আর আবাসিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারতাম, তাহলে পর্যটনখাতকে জাতীয় আয়ের অন্যতম খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারতাম।

আমি দেখেছি, দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটনে বিশেষ সফলতাও এসেছে। শতকরা ৮০ ভাগ পর্যটকই দেশের এবং দেশের মধ্যকার দর্শনীয় জায়গাগুলো দেখতে বেরিয়ে পড়ছেন। এটিকে সফলতাই বলতে হয় এবং এখান থেকে প্রচুর অর্থনৈতিক আয়ও হচ্ছে। পর্যটনখাতের সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলতে গেলে সবার আগে এর উন্নয়ন নিয়ে কথা বলতে হবে। কতটুকু উন্নয়ন, নিরাপত্তা দিতে পারছি, তার ওপরেই মানুষের ভ্রমণ আনন্দ নির্ভর করে।

জাগো নিউজ: এমন সম্ভাবনা থাকার পরও স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমরা কক্সবাজারকেই আন্তর্জাতিক মানের পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারলাম না…

রাশেদ খান মেনন: আমি যখন পর্যটনমন্ত্রী ছিলাম, তখন আন্তর্জাতিক মানের জায়গায় নেওয়া হয়েছিল কক্সবাজার সৈকতকে। এদেশের পর্যটনখাতের উন্নয়নে বিশেষ তাগিদ দিয়েছিলাম। সেই জায়গা থেকে সরে আসা হয়েছে বলে মনে করি।

এর মধ্যে প্রধানতম কারণ হচ্ছে করোনা মহামারি। করোনা মহামারির কারণে কোনো কিছুই আর স্বাভাবিক নেই। সবই তো উল্টাপাল্টা হয়ে গেছে। তবুও যিনি চালকের আসনে থাকেন, তার দায় তো থাকেই।

জাগো নিউজ: আর কী সমস্যা চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন, যা মানোন্নয়নে অন্তরায় বলে মনে করেন?

রাশেদ খান মেনন: পর্যটনকেন্দ্র আন্তর্জাতিক মানের তখনই হবে, যখন এখানে মানুষের বিনোদনের জায়গাটা নিশ্চিত হবে। আন্তর্জাতিক পর্যটনকেন্দ্রে যেসব বিনোদনের ব্যবস্থা রাখা আছে, তার অনেক কিছুই আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না।

আমাদের প্রস্তাব ছিল সমন্বয় করে বিনোদনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। যেমন, মালয়েশিয়ায় অনেক পর্যটনকেন্দ্রে এমন বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে যেখানে দেশীয়রা প্রবেশ করতে পারেন না। শুধু বিদেশিরা প্রবেশ করে থাকেন। ইন্দোনেশিয়াতেও তাই। এসব দেশে বিশাল পর্যটনশিল্প গড়ে উঠেছে।

জাগো নিউজ: তার মানে বার, ব্রথেল, ক্যাসিনোর মতো ব্যবস্থা না থাকায় বিদেশিদের ঠিক আকর্ষণ করা যাচ্ছে না?

রাশেদ খান মেনন: হ্যাঁ। আন্তর্জাতিক মানের গড়ে তুলতে হলে এগুলো তো আনুষঙ্গিক। বর্তমানে বিশ্বে এসব অস্বীকার করে আপনি পর্যটনের মান বাড়াতে পারবেন না।

আমার সময় এমন একটি এক্সক্লুসিভ পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু হয়নি। কক্সবাজারের অদূরে। এখন সেখানে ইকোনমিক জোন করা হয়েছে। চীন-রাশিয়া থেকে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয়েছিল সেখানে। শেষ পর্যন্ত আর হলো না।

জাগো নিউজ: আপনি বলছিলেন, শতকরা ৮০ ভাগ পর্যটকই দেশীয়। সেই বিবেচনাতেও তো উন্নয়ন জরুরি।

রাশেদ খান মেনন: অবশ্যই। বাঙালি ভ্রমণপ্রিয়। তারা বিদেশে গিয়ে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করছে। অথচ দেশের কেন্দ্রগুলো তাদের টানতে পারছে না। এটি অনুধাবন করার ব্যাপার। সম্প্রতি বিজয় দিবসে কক্সবাজারে আমরা অব্যবস্থাপনা দেখতে পেলাম। লাখ লাখ মানুষ। অথচ, সুবিধা নিশ্চিত করতে পারিনি। আমার সময় কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের উন্নয়নের চেষ্টা করেছি। পারিনি। বহু পক্ষের স্বার্থের কারণেই কক্সবাজার সৈকতের বেহাল দশা।

জাগো নিউজ: পক্ষগুলো কারা? কাদের স্বার্থ?

রাশেদ খান মেনন: ব্যক্তির স্বার্থের চেয়ে এখানে অথরিটির (কর্তৃপক্ষ) স্বার্থ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। কেউ ছাড় দিতে চায় না। জেলা প্রশাসকের হাতে ক্ষমতা থাকবে, নাকি কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের হাতে ক্ষমতা থাকবে, নাকি পর্যটন অধিদপ্তরের হাতে ক্ষমতা থাকবে এ নিয়ে ব্যাপক দ্বন্দ্ব আছে।

জাগো নিউজ: তার মানে এই দ্বন্দ্ব পর্যটনখাতের উন্নয়নের অন্তরায়?

রাশেদ খান মেনন: অবশ্যই। এই দ্বন্দ্বের কারণেই আমার সময় অনেক সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। জেলা প্রশাসকের হাতে ক্ষমতা। আবার পর্যটন বিভাগও রয়েছে। ট্যুরিস্ট পুলিশও রয়েছে। সৈকতটা আসলে কার হাতে থাকবে, তার কোনো স্পষ্ট নীতি নেই।

আমার সময় ট্যুরিস্ট পুলিশ গঠন করা হয়। তাদের জন্য আলাদা প্রশিক্ষণ, আলাদা নীতি নেওয়ার কথা ছিল। তা হয়নি। সাধারণ পুলিশের মতো আচরণ করলে তো মানুষ সত্যিকার সেবা পাবে না।

জাগো নিউজ: অভ্যন্তরীণ পর্যটকদের জন্য আরেকটি সমস্যা হচ্ছে থাকা-খাওয়ার অত্যধিক মূল্য। মনিটরিং নেই, জবাবদিহি নেই। এটিকে কীভাবে দেখবেন?

রাশেদ খান মেনন: এটি বাংলাদেশেই সম্ভব। সাধারণত পর্যটনকেন্দ্রে খাবার বা আবাসিক সেবার মূল্য বেশি হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো পর্যটনকেন্দ্রে সেবার অধিক মূল্য বিশ্বের আর কোথাও নেই। একেবারে পর্বতসম মূল্য এখানে।

অন্য দেশেও পর্যটন মৌসুমে দাম বাড়ে। আমাদের এখানেও বাড়বে স্বাভাবিক। কিন্তু আকাশচুম্বি বৃদ্ধি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

জাগো নিউজ: এর দায় কার?

রাশেদ খান মেনন: জবাবদিহি না থাকার কারণেই এমন হচ্ছে। আপনি দার্জিলিং গিয়ে যে টাকায় যে মানের হোটেল পাবেন, তার দ্বিগুণ টাকা গুনতে হবে কক্সবাজাবাজারে।

এখানকার ব্যবসায়ীরা মনে করেন, সুযোগ পেলে একদিনেই সারা বছরের খরচ তুলে নিতে হবে। এটা ঠিক নয়। সাধারণ মানুষ নিরাশ হচ্ছে।

এই চিত্র না থাকলে আমরা একমাত্র কক্সবাজার দিয়েই বহুদূর এগিয়ে যেতে পারতাম। অধিক লোভের কারণেই সেটা সম্ভব হচ্ছে না।

জাগো নিউজ: তার মানে সরকারগুলোর পরম্পরায় ব্যর্থতার কারণেই এমন চিত্র…

রাশেদ খান মেনন: কক্সবাজারের সর্বপ্রথম গুরুত্ব অনুধাবন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু সেখানে ঝাউবন তৈরি করে তার সংরক্ষণ এবং সৈকতের উন্নয়ন শুরু করেন। শেখ হাসিনার সরকারও কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। তার আমলেই কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর তৈরি করা হয়েছে।

সমস্যা ঠিক আরেক জায়গায়। কক্সবাজারে মৌলবাদী গোষ্ঠী এতই শক্তিশালী যে চাইলেই সব করা যায় না। এই মৌলবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগও যুক্ত। মূলত মৌলবাদীদের কারণেই কক্সবাজার সৈকতের উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না।

আমি সেখানে প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছি। আমাকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে বাড়তি ঝামেলা সৃষ্টি করার কী দরকার? আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, মৌলবাদী গোষ্ঠী চায় না কক্সবাজার আন্তর্জাতিক মানের পর্যটনকেন্দ্র হোক।

আবার আন্তঃমন্ত্রণালয়ও এখানে নানা জটিলতা সৃষ্টি করে রাখে। যেমন বন বিভাগ মনে করে পর্যটনকেন্দ্রগুলো তাদের। এত সমস্যা নিয়ে আসলে একটি সেক্টর দাঁড়াতে পারে না।

‘মৌলবাদীদের কারণেই কক্সবাজার সৈকতের উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না’

দেশের ভ্রমণপিপাসুদের অন্যতম আকর্ষণীয় স্পট বান্দরবান/ফাইল ছবি

জাগো নিউজ: এক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কী?

রাশেদ খান মেনন: আমি মনে করি, ট্যুরিজম অথরিটিকে পুরো দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া দরকার। এখানে ব্যবসাটা মুখ্য করে দেখলে চলবে না। মানুষের সেবাটাও নিশ্চিত করতে হবে।

জাগো নিউজ: দেশের অন্যান্য পর্যটনকেন্দ্র নিয়ে কী বলবেন?

রাশেদ খান মেনন: সিলেটের এমন কিছু জায়গা আছে, যেখানে হয়তো পর্যটকরা এখনো যায়নি। যেমন সিলেটের বিছানাকান্দির পুরো অঞ্চলটাই পর্যটন এলাকা মনে করি। এমন প্রকৃতির রূপ কোথায় মিলবে? আমি গিয়ে বিমোহিত হয়েছি।

দেশের বহু জায়গা রয়েছে এমন। আমরা সংরক্ষণ বা উন্নয়ন করতে পারিনি। নিরাপত্তা আর উন্নয়ন করতে পারলে গোটা বাংলাদেশকেই পর্যটন স্পটরূপে গড়ে তোলা সম্ভব।

‘মৌলবাদীদের কারণেই কক্সবাজার সৈকতের উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না’

সিলেটও পর্যটকদের অন্যতম গন্তব্য/ফাইল ছবি

জাগো নিউজ: সম্প্রতি কক্সবাজারে একটি হোটেলে এক নারী পর্যটক ধষণের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে। পুলিশ-র‌্যাব ভিন্ন ভিন্ন বার্তা দিচ্ছে। এই ঘটনা কী প্রভাব ফেলবে পর্যটনে?

রাশেদ খান মেনন: অত্যন্ত দুঃখজনক। এই ঘটনা সবার মনে দাগ কেটেছে এবং পর্যটকদের মধ্যে প্রভাব ফেলবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

সবচেয়ে অবাক করেছে পুলিশ এবং র‌্যাব ভিন্ন ভিন্ন কথা বলছে। একজন যৌনকর্মী হলেই তাকে ধর্ষণ করতে হবে? কোন সমাজে আছি আমরা? মূল ঘটনার বিচার না করে এমন আলোচনা সামনে এনে ঘটনা চাপা দেওয়ার চেষ্টা চলে মাত্র।

পুলিশ আসলে করছে কী? ট্যুরিস্ট পুলিশ আছে। প্রশাসন আছে। তাদের কাজটা কী? মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *